
ছবি: ভিক্টর গ্রিগাস/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
শুরুতে স্বীকার্য, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন ভাষায় উইকিপিডিয়ার বিস্তার ও পরিসর যেমন বেড়েছে, অ্যাকাডেমিক অঙ্গনে উইকিপিডিয়া এখনও ততোটা প্রভাবশালী হয়ে ওঠেনি। অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রকে যদি দুটো ভাগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, গবেষণা-প্রবন্ধে (journal paper) তথ্যের সূত্র হিসেবে উইকিপিডিয়ার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। অপরদিকে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত কাজে ও শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজনে উইকিপিডিয়ার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উইকিপিডিয়ার ব্যবহার ও অ্যাকাডেমিয়ায় উইকিপিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে গত দশ বছরে যেসব গবেষণা হয়েছে, সেগুলোতে এসব ফলাফল উঠে এসেছে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যেকোনো সময়েই তথ্যের প্রয়োজন হতে পারে। দরকার হতে পারে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর সুগভীর বর্ণনা। একসময় এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বা মাইক্রোসফ্ট এনকার্টা এসব ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো; যদিও তা উইকিপিডিয়ার মতো এতোটা বিস্তারিতভাবে নয়। উইকিপিডিয়ার দ্রুত বিস্তৃতি, তথ্যের পরিসর ও গভীরতার পাশাপাশি নিবন্ধের বিপুল আয়তনের সঙ্গে সেগুলো টিকে থাকতে পারেনি।
উইকিপিডিয়ার একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, একজন শিক্ষার্থী যখন তার পড়া বিষয়ের ওপর কোনো তথ্য খুঁজতে যায়, তখন সেই তথ্য ব্যবহারকারীর নিজস্ব ভাষায় না থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় উক্ত নিবন্ধ বা নিবন্ধটির সঙ্গে সম্পর্কিত অন্য কোনো নিবন্ধ ইংরেজি বা ব্যবহারকারী জানে, এমন অন্য কোনো ভাষায় রয়েছে। সুতরাং, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর আগ্রহের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক এমন একাধিক নিবন্ধ একজন শিক্ষার্থী একইসঙ্গে পেয়ে যাচ্ছে।
এ-প্রসঙ্গে এও বলা যায়, উইকিপিডিয়া একাধিক নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে তথ্য নিয়ে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের সারমর্ম প্রদান করে। এ-থেকে পাঠক ওই বিষয়ে ধারণা লাভ করেন এবং পরবর্তীতে উক্ত বিষয়ে আরও বিস্তর গবেষণা করতে পারেন।
উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে যখন তথ্য খুঁজতে যান, তখন তাদের জন্য তথ্যের সর্বাধিক যে বৈশিষ্ট্যটি প্রয়োজন সেটি হচ্ছে নির্ভরযোগ্যতা। উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো যে-কেউ সম্পাদনা করতে পারেন বলে অনেক সময় তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা হারায়।
এ-ও সত্যি, উইকিপিডিয়ায় যেসব ভালো বা নির্বাচিত নিবন্ধ থাকে, সেগুলোর তথ্য অনায়াসে গ্রহণ করা যায়। এসব নিবন্ধে চাইলেই ভুল বা অসত্য তথ্য যোগ করা যায় না, কারণ অন্যান্য নিবন্ধ-লেখক কিংবা সম্পাদক-প্রশাসকরা এসব নিবন্ধের পরিবর্তনের ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি কড়া নজর রাখেন। ফলে এসব নিবন্ধের তথ্য দ্বিধা ছাড়াই গ্রহণ করা যায়।
শিক্ষার্থীদেরকে তাদের কোর্সের বিষয়বস্তু এবং সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞান রাখতে হয়। উইকিপিডিয়া সেই চাহিদাও পূরণ করে। সাম্প্রতিক বিষয়াবলীর ওপর নিবন্ধ উইকিপিডিয়ায় দ্রুত স্থান করে নেয়। উদাহরণস্বরূপ ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলার ওপর নিবন্ধটি তথ্যসূত্রসহ দ্রুতই উইকিপিডিয়ার বিভিন্ন ভাষায় স্থান করে নেয়।
যেকোনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় উইকিপিডিয়াতেই। শিক্ষার্থীদের শুধু লেখাপড়াই নয়, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও তাই উইকিপিডিয়া সহায়তা করে থাকে। একইসঙ্গে, উচ্চশিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনেও উইকিপিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলা উইকিপিডিয়ার দশম বার্ষিকী উপলক্ষে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে বাংলা উইকিপিডিয়া স্কুল প্রোগ্রাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকগণ বিভিন্ন জার্নালে গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই ক্ষেত্রে উইকিপিডিয়াকে এখনও গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয় না। তবে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গবেষণা-প্রবন্ধ লেখার সময় প্রাথমিক কিছু সহায়তা নিতে পারেন উইকিপিডিয়া থেকে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন বিষয়ে কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে উইকিপিডিয়া থেকে এর হদিশ মিলবে।
এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে সুবিধাটি হয়, সেটি হচ্ছে, উইকিপিডিয়ার নীতিমালা অনুসারে প্রতিটি নিবন্ধে সংশ্লিষ্ট তথ্যের সূত্র দিতে হয়। ফলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকবৃন্দ নিবন্ধের নিচে সংশ্লিষ্ট ও প্রাসঙ্গিক একাধিক তথ্যসূত্র পাচ্ছেন একসঙ্গেই। এসব তথ্যসূত্র ব্যবহার করে গবেষকবৃন্দ তাঁদের তথ্য খোঁজার পরিসর আরও বিস্তৃত করতে পারেন পরবর্তী সময়ে।
উইকিপিডিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, আগ্রহ, ব্যবহার ও এর কার্যকারিতা গবেষকদের একটি অন্যতম আগ্রহের কেন্দ্র। শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষত কলেজ ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে, উইকিপিডিয়ার ব্যবহার নিয়ে এখন প্রচুর গবেষণাও হচ্ছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক জরিপ থেকে দেখা যায়, তারা উইকিপিডিয়া ব্যবহার করেন মূলত বিভিন্ন বিষয়ের পটভূমি-সম্পর্কিত তথ্যের জন্য।
বিশেষ করে, স্থাপত্য, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের কোর্সের সঙ্গে সম্পর্কিত গবেষণার জন্য উইকিপিডিয়া ব্যবহার করেন। গবেষণা প্রক্রিয়া শুরুর দিকে তাদের উইকিপিডিয়া ব্যবহারের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, কোনো একটি বিষয়ের সারসংক্ষেপ জানার জন্য উইকিপিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে, যে বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে, সেই বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত শব্দ আর সেগুলোর ব্যাখ্যার জন্য উইকিপিডিয়া সহায়ক।
অপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত ব্যবহার, ক্লাসের প্রকল্প ও মনোবিজ্ঞান-সম্পর্কিত লেখাপড়ায় উইকিপিডিয়া ব্যবহার করছেন। শিক্ষার্থীরা যখন বিভিন্ন কাজে ব্রাউজারে তথ্যের সন্ধান করেন, তখন উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো সামনের কাতারে থাকে। তিনটি গবেষণার সারসংক্ষেপ থেকে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষের কোর্স-সম্পর্কিত কাজের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা গবেষণা-বিষয়ক কাজেও উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ ব্যবহার করেছেন।
প্রায় সতেরশ’ শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত এক জরিপের ফল অনুসারে, ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থীই তাদের অ্যাকাডেমিক কাজে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করছেন। এদের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ উইকিপিডিয়ার ব্যবহারকে খুব কার্যকর বলে মনে করেন।
সুতরাং, সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, উইকিপিডিয়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোভাব মূলত ইতিবাচক এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তারা শিখন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করছেন। এই উদাহরণগুলো দেয়া হয়েছে উইকিপিডিয়ার প্রতি শিক্ষার্থীদের মনোভাব কীরকম, তা উপলব্ধির জন্য। এর বাইরেও উইকিপিডিয়ার ব্যবহার নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে।
অ্যাকাডেমিয়াতে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় বিষয়। গবেষণার ফলাফল অনুসারে, শিক্ষকরাও তাদের শিক্ষণ-প্রক্রিয়ায় উইকিপিডিয়াকে কার্যকর বলে মনে করছেন। সুতরাং, শিখন ও শিক্ষণ উভয় ক্ষেত্রেই উইকিপিডিয়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের কাছে ক্রমান্বয়ে গৃহীত হচ্ছে। অন্য একটি গবেষণা জানাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আকর্ষণীয় অ্যাসাইনমেন্ট প্রদানে উইকিপিডিয়া ও উইকি-সম্পর্কিত অন্য প্রজেক্টগুলোও শিক্ষকরা ব্যবহার করছেন।
উইকিপিডিয়া যেহেতু তথ্যের ভাণ্ডার, তাই এটি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি কার্যকর উপাদান হিসেবে কাজ করবে, এই আশা করা যেতে পারে। উইকিপিডিয়ার বৈশিষ্ট্য ও অ্যাকাডেমিয়ার কিছু কাঠামোবদ্ধ নিয়মের কারণে এখনও এই দুটো ক্ষেত্রের বন্ধন শক্তিশালী নয়। উইকিপিডিয়ার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবহারের অসাঞ্জস্যতাও লক্ষ করা যায়, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ্যাকাডেমিয়ায় উইকিপিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
গবেষণার তথ্য অনুসারে, ২০১০ বা তার পর থেকে উচ্চশিক্ষায় উইকিপিডিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের মান বাড়লে শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ যেমন উইকপিডিয়ার তথ্যসূত্র ব্যবহার করতে স্বচ্ছন্দবোধ করবেন, তেমনি গবেষণাকাজে উইকিপিডিয়ার ব্যবহারও উইকিপিডিয়াকেও অধিকতর দায়বদ্ধ হতে সহায়তা করবে।
লেখক: গৌতম রায়, সহকারী অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ