
উইকিমিডিয়া উইকিমিট ভারতের লোগো। ছবি: সুশান্ত সাভলা/সিসিবাইএসএ ৪.০
২০২০-এর নভেম্বর মাসের দিকে ভারতে একটা উইকিমিট আয়োজনের ব্যাপারে প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়। বিষয়টা এমনও ছিলো না যে, কোভিড-১৯-এর বৈশ্বিক মহামারির কারণে ভারতে সকল অফলাইন অনুষ্ঠান আয়োজনে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে কিংবা লকডাউন চলছে বলেই আমরা অনলাইনে এমন একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করতে চলেছি, বরং পরিকল্পনাটার শেঁকড় ছিলো আরো বহু আগের।
আমরা অনলাইনে আরও বেশি করে উইকি অনুষ্ঠান করার চিন্তা-ভাবনা বেশ অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম। কিন্তু বাস্তবায়ন করার ইচ্ছাটা ত্বরান্বিত করেছে ভারতের লকডাউন পরিস্থিতি – এতে কোনো সন্দেহ নেই। কী করব, কীভাবে করব, কেন করব – সেসব নিয়ে সবসময়ই আমাদের মধ্যে কিছু সংশয় থাকলেও এটা বুঝে গিয়েছিলাম আমরা নতুন কিছু একটা শিখব: হতে পারে আমরা পরিকল্পনা করলাম, কিন্তু সেভাবে স্বেচ্ছাসেবকরা কাঙ্ক্ষিত সাড়া দিলেন না; সেক্ষেত্রেও আমাদের কাছে কিছু শিক্ষণীয় বিষয় থাকবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় সহায়ক হবে।
উইকিমিডিয়া উইকিমিট নিয়ে যারা চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে নিজের মাতৃভাষা নিয়ে বেশ উৎসাহ ছিলো বলেই হয়তো ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঐ দিনটিই সর্বাগ্রে ঠাঁই পেয়েছিলো। প্রাণের কাছাকাছি এই ভাষাকে ভালোবেসেই, ভাষার টানেই, ভাষার সান্নিধ্যে থাকার নিমিত্তেই উইকিমিডিয়ানরা বাংলা উইকিমিডিয়ার বিভিন্ন প্রকল্পে স্বেচ্ছাশ্রমে রত। ভাষা দিবসকে সঙ্গে নিয়ে তাই শুক্র-শনি-রবি মিলিয়ে সপ্তাহান্তের দিনগুলোই বাছাই করা ঠিক করা হলো, যাতে ভারতীয়রা কর্মব্যস্ত সময়ের পরে কিছুটা সময় বের করতে পারেন।
অনুষ্ঠান পরিকল্পনার পাশাপাশি, অনুষ্ঠানের প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে, শুরুর আগেই আমরা ৫টি ব্লগ প্রকাশ করেছি, তিনবার এই বিষয়ে ‘মন্তব্যের জন্য আহবান’ প্রক্রিয়া চালিয়েছি, ছয়টি নিউজলেটার প্রকাশ করেছি। এর ফলস্বরূপ আমরা ৪০টির মতো সাবমিশন বা উপস্থাপন প্রস্তাব পেয়েছিলাম। তার মধ্যে থেকে আমাদের প্রোগ্রাম কমিটি ৩১টি উপস্থাপনা মূল অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন করেছিলেন।
যেহেতু এই ধরনের অনলাইন অনুষ্ঠান আমরা প্রথম করছি, সেজন্য আমরা ভারতীয় সম্প্রদায়ের কাছে কিছু প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তার কথা (হতে পারে ইন্টারনেট সংযোগ কিংবা ডিভাইস ইত্যাদি) জানিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আমরা ৬৯২ জনের কাছ থেকে আবেদন পাই, তার মধ্য থেকে ৩১৮ জনকে তাঁদের উইকিমিডিয়ার অভিজ্ঞতা অনুসারে আমরা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য বাছাই করি।
দ্বিতীয় যে বিষয়টা নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো, তা হলো, কোন প্ল্যাটফর্মে আমাদের মূল অনুষ্ঠান করা হবে। সর্বাগ্রে গুগল মিট আর জুমের কথা এলেও আমাদের আলোচনায় জুমের কিছু উপযোগিতা বেশি থাকার ফলে আমরা গুগল মিটের বদলে জুম প্ল্যাটফর্মে আমাদের অনুষ্ঠান করবো বলে স্থির করি।
অবশেষে আমাদের অপেক্ষার প্রহরে ইতি টেনে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান: বাছাইকৃত ৩১টি উপস্থাপনা তিনদিন ধরে আমরা আগ্রহী অংশগ্রহণকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। এর মূলভাগে আমরা অনেক স্বেচ্ছাসেবকেরও সহায়তা পেয়েছি, যাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম না করলেই নয়: আসফ বার্তোভ, রবিশঙ্কর আইয়াক্কান্নু, কিরিল সাইমনোভস্কি, তনবীর হাসান, কৃষ্ণচৈতন্ন ভেলাগা, সতদীপ গিল, অংকন ঘোষ দস্তিদার, ড: মানবপ্রীত কঊর, শাবাব মুস্তাফা প্রমুখ। এসকল অভিজ্ঞ উইকিমিডিয়ানরা মূল অনুষ্ঠান সঞ্চালনার কাছে বিশেষভাবে সহায়তা করে আমাদের ঋণী করেছেন। প্রোগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে কিরিল সাইমনোভস্কি, নেতা হুসেন, মাহির মোর্শেদ ও শ্যামলের অশেষ সহায়তা আমরা পেয়েছি।
এদিকে আমাদের নিজস্ব সমন্বয়কারী দল কলকাতায় একটি স্থানে থেকে মূল অনুষ্ঠানটিকে সম্প্রচার করেছিলাম। সেই দলে ছিলেন টিটো দত্ত, নিতেশ গিল, সুবোধ কুলকার্নি, বোধিসত্ত্ব মন্ডল আর আমি। আমাদের সম্বন্বয়কারীদলের কাজ ছিলো উপস্থাপনাকারীদেরকে সঠিক সময়ে তাদের উপস্থাপনার জন্য মনে করিয়ে দেওয়া।
আসফ বার্তোভ, সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার, উদীয়মান উইকিমিডিয়া সম্প্রদায়গুলো আর উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমাদের অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক ভাষণ দেন। দ্বিতীয় দিন সকালের বিশেষ অধিবেশনে বিশেষ বক্তৃতা প্রদান করেন উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন মাহের।
পুরো অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষণীয় যে বিষয়গুলো ছিলো, তা হলো আমাদের প্রত্যাশার ৩১৮ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন অংশগ্রহণকারীকে আমরা সর্বদা পেয়েছি। তারা প্রায় সবসময় বিভিন্ন বিষয়ের উপস্থাপনায় অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা আর ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যার কারণে অল্প কিছু ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের মাঝে ব্যাঘাত ঘটেছে।
তিনদিনব্যাপী অনুষ্ঠানটি শেষ হয় শাবাব মুস্তাফার বক্তব্য দিয়ে, যিনি উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, নির্বাহী কমিটির একজন নির্বাচিত সদস্য এবং উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের তৎকালীন সভাপতি। তিনি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস — ভাষার প্রতি ভালবাসা এবং নীরবতার শব্দ” শিরোনামে তাঁর বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানের অনেক ভালো ভালো স্মৃতিবহ মুহূর্ত নিয়ে আমরা আমাদের প্রথম উইকিমিডিয়া উইকিমিট শেষ করেছি।