
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকিপিডিয়া কর্মশালা। ছবি: উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
উইকিপিডিয়া এমন একটি বিশ্বকোষ যা ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় যে-কেউ ব্যবহার করতে পারেন। এ-কারণেই বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ওয়েবসাইটের মধ্যে উইকিপিডিয়া একটি। এমন সহজলভ্য একটি জ্ঞানভান্ডার দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন অবদান রাখছে, তেমনি অবদান রাখছে শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রেও। গত ২০২০-এর ২৬ ডিসেম্বর তারিখে বাংলা উইকিপিডিয়া এক লাখ নিবন্ধের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এটি অবশ্যই বাংলা উইকিপিডিয়ার জন্য একটি বড় অর্জন; তবে বাংলা উইকিপিডিয়ার আরও অনেক অর্জনের সুযোগ রয়েছে। এসব অর্জনের একটি হচ্ছে, বিভিন্ন পেশাগোষ্ঠীর মানুষ কর্তৃক তাৎপর্যপূর্ণভাবে উইকিপিডিয়ার ব্যবহার বাড়ানো। বাংলা উইকিপিডিয়ার এক লাখ নিবন্ধ অর্জন উপলক্ষে এই লেখায় শিক্ষাক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ার ব্যবহারের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। উইকিপিডিয়াকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কিভাবে আরও ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে পারেন, সেটিই এই লেখার মূল বিষয়।
২০০১ সালের ১৫ জানুয়ারি উইকিপিডিয়া যাত্রা শুরু করে। যাত্রা শুরুর প্রথম দিকে বিভিন্ন কারণে উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। ফলে, শিক্ষক ও গবেষকরা উইকিপিডিয়ার ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতেন। যেহেতু উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো যে-কেউ সম্পাদনা করতে পারে, ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ার ব্যবহার এখনও অনেক ক্ষেত্রে এসব কারণে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে, দিন দিন উইকিপিডিয়া এ-অবস্থা কাটিয়ে উঠছে। এখন ইন্টারনেটে যেকোনো তথ্য খুঁজলে বেশিরভাগ সময় উইকিপিডিয়াকেই সবার উপরে দেখা যায়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, মাতৃভাষায় সাবলীলভাবে এক জায়গায় বেশি তথ্য পাওয়ার কারণে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা উইকিপিডিয়া ব্যবহারে আগ্রহ দেখান। ফলে, বেশ কিছুদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা নতুনভাবে চিন্তা করা শুরু করেছেন কেন ও কিভাবে উইকিপিডিয়ার ব্যবহার শিক্ষাক্ষেত্রে বাড়ানো যায়। এটি বারবার আলোচনায় এসেছে যে, এমন একটি উন্মুক্ত বিশ্বকোষ যেখানে যে-কেউই সম্পাদনা করতে পারেন কিন্তু তথ্যের বিপুল সমাহার রয়েছে, সেখানে একে নিরুৎসাহিত করার পরিবর্তে কিভাবে দায়বদ্ধতার সাথে আরও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, সেই বিষয়ে জোরালোভাবে ভাবা প্রয়োজন।
২০১০ সালে হার্ভার্ডের বেশ কয়েকজন অধ্যাপক এমন এক উদ্যোগ নেন যার ফলে উইকিপিডিয়া এক অন্যমাত্রার বিশ্বাসযোগ্যতা লাভ করে। শিক্ষার্থীরাও উইকিপিডিয়ায় সম্পাদনা করতে নতুনভাবে আগ্রহী হয়। এই শিক্ষকরা মিলে তাঁদের শিক্ষার্থীদের নম্বর বণ্টনের জন্য পরীক্ষা নেওয়ার বদলে তাদেরকে দিয়ে উইকিপিডিয়ায় সম্পাদনা ও নিবন্ধ তৈরির কাজে নিয়োজিত করেন [১]। সে-বছর শিক্ষার্থীরা উইকিপিডিয়ায় প্রায় ৫৮০০ পৃষ্ঠার নির্ভুল ও বিশ্বস্ত তথ্য যোগ করেন। এভাবে উইকিপিডিয়া তার যাত্রায় নতুন এক মোড়ের সূচনা করে। অন্যদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, ঠিক হার্ভার্ডের মতো পরীক্ষার বিকল্প হিসেবে না হলেও শিক্ষকদের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধায়নে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি-নির্ধারিত কাজের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা উইকিপিডিয়ায় নিবন্ধ তৈরি করে। শিক্ষকদের তত্ত্বাবধায়নে তারা সকলে মিলে প্রথমে তাদের পাঠ্যবিষয়-সম্পর্কিত নিবন্ধগুলো খুঁজে বের করে [২][৩]। তারপর বোঝার চেষ্টা করে, কোন নিবন্ধগুলোর আরও সম্পাদনা ও সংযোজন প্রয়োজন, এবং কোন বিষয়গুলো নিয়ে নতুন নিবন্ধ তৈরি করতে হবে। এরপর শিক্ষকের নির্দেশনায় তারা সম্পাদনা ও নতুন নিবন্ধ তৈরি শুরু করে। এতে শিক্ষার্থীরা যেমন উইকিপিডিয়ায় সম্পাদনার দক্ষতা অর্জন করতে পারে তেমনি উইকিপিডিয়াও সমৃদ্ধ হয়।
এ-পদ্ধতিতে আমাদের দেশেও প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়ার নির্ধারিত কাজের সাথে উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ লেখা ও সম্পাদনার কাজ সংযুক্ত করা যেতে পারে। ধরা যাক, পদার্থবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক যদি তাঁর শ্রেণির ৩০ জন শিক্ষার্থীকে পদার্থবিজ্ঞানের ৩০টি বিষয়ে নিবন্ধ লেখার কথা বলেন, এবং লেখা শেষ হলে প্রত্যেককে পরস্পরের নিবন্ধ পর্যালোচনার জন্য বলেন, তাহলে প্রতিজন শিক্ষার্থী একই সঙ্গে ওই ৩০টি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করতে পারবে। কিংবা ইতোমধ্যে যেসব নিবন্ধ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের দ্বারা সেগুলো পর্যালোচনা করিয়ে সম্পাদনা করালেও শিক্ষার্থীরা লেখার মাধ্যমে সরাসরি শিখতে পারবে। এভাবে নানা কৌশলে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে উইকিপিডিয়ার সাথে যুক্ত রেখে শিখন-শিক্ষণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে পারেন। অন্যদিকে, উইকিপিডিয়া ভাষাশিক্ষার ও নতুন ভাষা শেখার পর তা চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করতে পারে। যেহেতু উইকিপিডিয়াতে এক ভাষার নিবন্ধ অন্য ভাষায় অনুবাদের উৎসাহ দেওয়া হয়, সুতরাং যিনি একাধিক ভাষা জানেন, তিনি অনুবাদের মাধ্যমে তার অনুবাদ দক্ষতা ও লেখার দক্ষতাকে শাণিত করতে পারেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এভাবেও উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ করে তাদের ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি লেখনশৈলীর উন্নতি করতে পারেন।
কোনো কাজে শিক্ষার্থীরা যখন তথ্যের অনুসন্ধান করে, তখন তারা উইকিপিডিয়া ব্যবহার করতে পারে। কোনো তথ্য অনুসন্ধানে উইকিপিডিয়া দারুণ একটি সূচনা হিসেবে কাজ করবে। উইকিপিডিয়ায় যেকোনো তথ্যের যেসব তথ্যসুত্র ও সম্পর্কিত অন্যান্য প্রবন্ধের সন্ধান দেওয়া থাকে, সেগুলো থেকেও তারা তাদের প্রয়োজনীয় তথ্যের সন্ধান পেতে পারে। সেখানে প্রাপ্ত তথ্য তাদের আরও নির্ভরযোগ্য উৎসগুলোতে পরিচালিত করতে পারে। সেই হিসেবে, তথ্য অনুসন্ধানে উইকিপিডিয়া একটি গোছানো সূচনামাত্র। উইকিপিডিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা চাইলেই তথ্যের আরও গভীরে যেতে পারবে, বিস্তারিত জানতে পারবে।
তবে, শিক্ষা ও গবেষণাসহ যেকোনো কাজে যখন কোনো ব্যক্তি উইকিপিডিয়ায় অনুসন্ধান করবেন, তখন তাঁর কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। কোনো বই বা জার্নালে বিশেষজ্ঞরা যেভাবে তথ্য প্রকাশ করে থাকেন তার সাথে উইপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যের বেশ পার্থক্য রয়েছে। একারণে উইকিপিডিয়ায় প্রাপ্ত তথ্যের ওপর সম্পূর্ণভাবে সবসময়ে নির্ভর করা ঠিক হবে না, এবং উইকিপিডিয়া তা কখনও দাবিও করে না। কৌশলের সাথে ব্যবহার করতে পারলে উইকিপিডিয়া থেকে বেশ সহায়তা পাওয়া যায়। যেমন, উইকিপিডিয়ায় যেসব তথ্য দেওয়া থাকে, সেগুলোর সাথে সূত্র উল্লেখ করা থাকে। শিক্ষার্থী যদি কোনো বিষয়ে গবেষণা করে, তাহলে শিক্ষার্থী তার গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো নির্দিষ্ট নিবন্ধের নিচে ‘অন্যান্য উৎস’, ‘গ্রন্থলিপি’, বা ‘বহিঃসংযোগ’ থেকে প্রচুর সহায়তা পেতে পারে। অনেকক্ষেত্রে এসব নিবন্ধ প্রকৃত নিবন্ধের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। এমনকি, উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলোর নিচে যে পাদটীকা থাকে সেখান থেকেও তথ্যের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সূত্রের সন্ধান পাওয়া যাবে। সেগুলো থেকেও অনুসন্ধানকারী তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্যের সন্ধান পেতে পারে। এসবের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা উইকিপিডিয়ার অন্যান্য প্রকল্পগুলো থেকেও সহায়তা নিতে পারে। যেমন: উইকিউপাত্ত, উইকি প্রজাতি, উইকি সংবাদ, উইকি বিশ্ববিদ্যালয়, উইকি বই, উইকি সংকলন, উইকি অভিধান। দেখা যাচ্ছে, উইকিপিডিয়াই শুধু তথ্যের ক্ষেত্র নয়, বরং উইকির অন্য প্রজেক্ট থেকেও শিক্ষার্থীরা উপকৃত হতে পারে।
শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন তথ্যভাণ্ডারের পাশাপাশি আজকের এই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে উইকিপিডিয়ার প্রয়োজন উল্লেখযোগ্য। কারণ শিক্ষা একটি দীর্ঘজীবন প্রক্রিয়া। বর্তমানের তথ্য বিস্ফোরণের সময়ে তথ্যের সহজলভ্যতা প্রয়োজন। তথ্যের অনুপ্রবেশ আরও সহজলভ্য করতে উইকিপিডিয়া পালন করছে অগ্রগামী ভূমিকা। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্টের সময়ে উইকিপিডিয়া বেশ ভালো সহায়তা করে। উইকিপিডিয়ার তথ্যগুলো যেহেতু ক্রমাগত হালনাগাদ হতে থাকে, সেহেতু শিক্ষার্থীরা সহজেই হালনাগাদ তথ্যের সন্ধান পেয়ে যান। এই বিশ্বকোষ ব্যবহার করতে করতে শিক্ষার্থীরা তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বস্থতা সম্পর্কে অনেক ভালো ধারণা লাভ করতে পারে।
আধুনিক শিক্ষা, নতুন প্রযুক্তি, পাঠদানের পদ্ধতি, শেখার উপাদান, শেখার সংস্থান এবং বিষয়বস্তু ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। উইকিপিডিয়া শিক্ষার্থীদের নতুন কৌশলগুলো বুঝতে সহায়তা করে। সুতরাং, একুশ শতকে উইকিপিডিয়া আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একই সাথে, আধুনিক শিক্ষার সাথে যদি উইকিপিডিয়ার সফল সমন্বয় ঘটানো যায়, তবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদানে উইকিপিডিয়াও আরও সমৃদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য হবে। যেসব সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক শিক্ষক ও গবেষক উইকিপিডিয়া ব্যবহারে তাদের শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উইকিপিডিয়ার যৌথ প্রচেষ্টায় এসব সীমাবদ্ধতা সহজে দূর করা সম্ভব।
লেখক
হিয়া মুবাশ্বিরা: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।
গৌতম রায়: সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।
তথ্যসূত্র
১। https://www.gse.harvard.edu/news/ed/11/09/truce-be-told
২। https://libguides.butler.edu/facultystaff/wikipedia
৩। https://www.teachology.ca/knowledgebase/what-are-possible-wikipedia-assignment-designs/