
কর্মাশালায় উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য রাখছেন সংগঠনের সভাপতি শাবাব মুস্তাফা। ছবি: উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ
বঙ্গদেশের মানুষের মুখের ভাষা, প্রাণের ভাষা বাংলা হলেও আধুনিককালে কোনো ভাষার শক্ত অবস্থানে টিকে থাকতে হলে চাই সেই ভাষায় জ্ঞানের চর্চা এবং বাস্তবিক প্রয়োগ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ইংরেজি ভাষার কথা। ঔপনিবেশিকতা অবসানের পরেও ইংরেজির একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বলা যায় ইংরেজি ভাষায় জ্ঞানের প্রাপ্যতা। একই কারণে পূর্বে ইংরেজ উপনিবেশের অংশ না হয়েও নানা দেশের জ্ঞানপিপাসুগণ ইংরেজি ভাষা অধ্যয়ন এবং চর্চা করে ইংরেজি ভাষায় জ্ঞান আহরণ, পরিমার্জন ও সংযোজন করে চলেছেন।
মুদ্রার অপর পিঠে, বাংলা ভাষা আমাদের প্রাণের ভাষা হলেও বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত জ্ঞানচর্চার অভাব থাকায় বাংলা ভাষায় জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা প্রকট। এখনও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় জ্ঞান চর্চার বিষয়টি সার্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। এর অন্যতম বড় কারণও বাংলা ভাষায় জ্ঞানের প্রাপ্যতা অপ্রতুল। যার ফলে বাংলা ভাষায় জ্ঞানের বাংলায় জ্ঞান চর্চার অনুৎসাহ, আবার অনুৎসাহের কারণে অপ্রতুলতার মত একটি দুষ্টচক্রের পরিক্রমায় বাংলা ভাষা ক্রমশ জর্জরিত হয়ে চলেছে।
যুগ যুগে অচল অবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন গতিসঞ্চার করে নব নব দিগন্ত উন্মোচনে তরুণরাই অগ্রগণ্য হয়েছেন। বাংলা ভাষার বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং সহজপ্রাপ্যতার সাথে সাথে ইন্টারনেটের দুনিয়া যখন হাতের নাগালে এলো, তখন বাংলা ভাষার দুর্বল অবস্থান স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রাযুক্তিক অনগ্রসরতার কারণে নিজ অক্ষরমালা থাকাসত্ত্বেও ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার একটি অপসংস্কৃতি ধীরে ধীরে মহামারীরূপ ধারণের পথে ছিল। অপরদিকে বাংলা ভাষায় পরিচয়ে পরিচিত বাঙালি জনগোষ্ঠী হারাতে বসেছিল স্বীয় পরিচয়। এমন দুরবস্থা এই অঞ্চলের তরুণদের একটি অংশকে গভীরভাবে আন্দোলিত করে। এই তরুণেরা বুঝতে পেরেছিল যে ভাষাপ্রেম বা চেতনা শুধু মুখে বুলি আউড়ে প্রকাশ করলেই শেষ হয়ে যায় না। এর পেছনে শ্রম এবং মেধা ব্যয় করতে হয় এবং তাতেই তা পূর্ণতা পায়। ফলস্বরূপ তরুণদের হাত ধরেই সহজে বাংলা টাইপ করার একাধিক উপায় উদ্ভাবিত হয় এবং ক্রমশ তা জনপ্রিয়তা যায়। ইতিহাসের পাতায় এই আন্দোলনকে বাংলা কম্পিউটিং জনপ্রিয়করণ আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করা যায়।
সহজে বাংলা টাইপিংয়ের ব্যবস্থা হল। অনেকে তাদের ব্যক্তিগত ব্লগ বাংলায় টাইপ করে ইন্টারনেটে প্রকাশ করা শুরু করলেন। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে আলোচনার ভাষা হল বাংলা। বাংলা সংবাদ-মাধ্যমগুলো ইন্টারনেটে বাংলায় সংবাদ প্রকাশ করা শুরু করল। কিন্তু বাংলায় জ্ঞানের সংকলনের জন্য একটি উপযুক্ত প্লাটফর্মের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছিল। এই ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ছিল প্রায় শূণ্যের কোঠায়। অপরদিকে সেই সময়ে ইন্টারনেটের কারণে যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। “জ্ঞান হোক উন্মুক্ত, যেখানে পৃথিবীর সকলের সমান প্রবেশাধিকার থাকবে” – এইরূপ একটি মহৎ দর্শনে বলীয়ান হয়ে ২০০১ সালে উইকিপিডিয়া নামক একটি ওয়েব প্লাটফর্মের যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাসের পুণরাবৃত্তিতে আবারও কিছু তরুণের হাত ধরেই বাংলা ভাষা এই প্লাটফর্মে যুক্ত হল। ২০০৪ সালের ২৭ জানুয়ারি শুরু হল বাংলা উইকিপিডিয়া প্রকল্প।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত জ্ঞানের বাংলা সংকলনই হচ্ছে বাংলা উইকিপিডিয়া। এটি মূলত স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারাই গড়ে উঠেছে। সেইসাথে বলাই বাহুল্য, এর স্বেচ্ছাসেবীদের সিংহভাগই তরুণ। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের তরুণরাও একযোগে এতে কাজ শুরু করেন। শুরুতে হাতে গোনা অল্প কয়েকজন কাজ শুরু করলেও ধীরে ধীরে এর স্বেচ্ছাসেবী যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে নিবন্ধের সংখ্যা এবং মান। বর্তমানে (ডিসেম্বর ২০২০) এতে এক লক্ষাধিক বাংলা নিবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটিই বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকলন যা বিনামূল্যে যেকেউ ব্যবহার করতে পারেন।
বাংলা উইকিপিডিয়াতে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাসেবী বাড়লেও শুরুর দিকে বিষয়টি এত সহজ ছিল না। তরুণরা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ শুরু করলেও সহসাই আরো অনেক অনেক স্বেচ্ছাসেবীর প্রয়োজন অনুভূত হয়। নতুনদের কাছে উইকিপিডিয়া কী, এবং কেন এতে অবদান রাখা গুরুত্বপূর্ণ, সেই বার্তা কার্যকরীভাবে পৌঁছানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই বার্তা পৌঁছানোর জন্য বিচ্ছিন্নভাবে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সেই কার্যক্রমকে গতিশীল এবং সুশৃঙ্খল করার জন্য একটি সাংগঠনিক পরিকাঠামোর প্রয়োজন ছিল। এই লক্ষ্যে ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ।
উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ মূলত উইকিমিডিয়ানদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই সংগঠনের প্রধান কাজ হচ্ছে বাংলাদেশে উইকি আন্দোলন সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং নতুনদের এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হবার জন্য আহবান জানানো। বাংলা উইকিপিডিয়া সমৃদ্ধকরণের পাশাপাশি উইকিপিডিয়ার অন্যান্য সহযোগী প্রকল্পগুলো সমৃদ্ধকরণেও উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ কাজ করে চলেছে। নতুন উইকিপিডিয়ান ও উইকিমিডিয়ান তৈরিতে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে সচেতনতামূলক কর্মশালা, প্রশিক্ষণমূলক কর্মশালা আয়োজন ও পরিচালনা করে থাকে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। এছাড়া ইতোমধ্যে সক্রিয় উইকিপিডিয়ানদের জন্য উৎসাহমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমও পরিচালনা করে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। যেমন: নিবন্ধ প্রতিযোগিতা, সম্পাদনা সভা, উইকি আড্ডা, ফটোওয়াক, অনলাইন ক্রোড়পত্র প্রকাশ ইত্যাদি। সেইসাথে উইপিডিয়ার সহযোগী প্রকল্প উইকি কমন্সের জন্য আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণের বিষয়টির সমন্বয়কের ভূমিকাও পালন করে থাকে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে উইকিপিডিয়ানদের প্রতিনিধি সংগঠন হিসেবে কাজ করে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ।
২০১১ সালের ৩ অক্টোবর উইকিপিডিয়ার মূল তদারকি সংস্থা উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের অনুমোদিত সহযোগী সংস্থা হিসেবে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ অনুমোদন পায় এবং ২০১৪ সালের ৯ জুন এটির বাংলাদেশে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সাংগঠনিক পরিকাঠামোয় বর্তমানে (ডিসেম্বর ২০২০) উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের চারটি আঞ্চলিক সম্প্রদায় রয়েছে। যথা: চট্টগ্রাম উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়, রাজশাহী উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়, কুমিল্লা উইকিপিডিয়া সম্প্রদায় এবং চাঁদপুর উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়।
ইচ্ছা থাকলে যে সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তা করা সম্ভব তার একটি উদাহরণ উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হওয়ার ফলে এবং নানা রকম আইনগত সীমাবদ্ধতা থাকায় বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করবার আগ্রহ থাকলেও সীমিত সম্পদের কারণে অনেক সময়ই তার বাস্তবায়ন করা এক একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বরাবরই সীমিত সম্পদের কার্যকরী ব্যবহারের জন্য স্বেচ্ছাসেবীগণ বিভিন্ন উদ্ভাবনীয় পন্থা এবং বিকল্প ব্যয় সংকোচন নীতি উদ্ভাবন করে কাজ করেন, যার ফলাফল অত্যন্ত আশাপ্রদ।
যেকোনো দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে জ্ঞান চর্চার সবচেয়ে বড় জায়গা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে উইকি আন্দোলনের মূল দর্শন সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলা এবং তাদের সম্পৃক্ততা আরো বাড়ানোর জন্য উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ শুরু থেকেই নিয়মিত কাজ করে এসেছে। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রম আরো সুসংহত এবং সুসংগঠিত করার জন্য উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ পরিকল্পনা করছে। সেই সাথে আন্তর্জাতিকভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময়ে কর্মসূচী জোরদার করবার পরিকল্পনাও রয়েছে।
বাংলা উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য সহযোগী প্রকল্পগুলো সমৃদ্ধ করার মহৎ উদ্দেশ্যের পাশাপাশি সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের আদর্শিক এবং দার্শনিক অবস্থান গ্রহণের ফলে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবীগণের ব্যক্তিগত মেধা ও ব্যবস্থাপকীয় দক্ষতা যে বিকাশের সুযোগ ঘটছে তার কারণে স্বেচ্ছাসেবীগণও সামাজিক সম্পদে পরিণত হবার সুযোগ পাচ্ছেন। উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের সাথে যে-কেউই কাজ করতে পারেন। এই অগ্রযাত্রার পথে পথিক হতে আপনিও আমন্ত্রিত।