
ছবি: বাংলা উইকিপিডিয়ার স্ক্রিনশট
ডিসেম্বর ২০২০। কয়েকদিন আগে থেকেই আভাস পেয়েছিলাম। কিন্তু যখন ইমেইলটা এলো, জানতে পারলাম বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়েছে, তখন আনন্দে মনটা ভরে গেল, আর শিহরিত হয়ে উঠলো আমার মনপ্রাণ সবকিছুই।
এ অনেক দিনের একটা স্বপ্নের ব্যাপার।
বিশ্বের প্রথম সাতে থাকা ভাষা – আমাদের মাতৃভাষা বাংলা – অনলাইনে এক সময় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। আজকে ২০২০ সালে বসে ব্যাপারটা ভাবা হয়তো অনেক কঠিন। কিন্তু ২০০১/২০০২/২০০৩ সালের দিকে অনলাইনে বাংলা ভাষায় কিছু খুঁজে পাওয়া ছিল একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। আলাপ আলোচনা আড্ডা হতো নানা মেইলিং লিস্ট কিংবা চ্যাটে, সবটাই ইংরেজি হরফে লেখা বাংলায়। আর জ্ঞানবিজ্ঞানের কিছু বাংলায় অনলাইনে? তা তো একেবারেই নেই। বিশ্বকোষ বা জ্ঞানভাণ্ডার অনলাইনে যা আছে, তার সবই ইংরেজি ভাষায়।
আমি তখন পিএইচডি শুরু করেছি মাত্র। সারাদিন অনলাইনে কাটে। উইকিপিডিয়ার বয়স তখন দুই তিন বছর মাত্র। নিজেই এডিট করা যায় এমন আশ্চর্য সাইট দেখে আমি মুগ্ধ। জড়িয়ে পড়লাম লেখালেখিতে। ২০০৪ সালের এই সময়টায় আমার হঠাৎ খেয়াল হলো, এমনকি ইংরেজি উইকিপিডিয়াতেও বাংলাদেশের সম্পর্কে তথ্য একেবারেই নেই। রিসার্চের ফাঁকে ফাঁকে শুরু করে দিলাম তথ্য যোগ করা। এক সময়ে নেশার মত হয়ে গেল – মাসে কয়েক হাজার করে এডিট করতে লাগলাম। কিন্তু এটা তো একার কাজ না। তাই রীতিমত হাতে পায়ে ধরে কয়েকজনকে জোগাড় করলাম। আস্তে আস্তে বাংলাদেশের কথা যোগ হতে লাগলো।
ইংরেজি উইকিটা কিছুটা গুছিয়ে আনার পরে খেয়াল হল, বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী তো ইংরেজিতে কথা বলে না। জ্ঞানবিজ্ঞানের এই বিশাল ভাণ্ডারে তাদের অধিকার আছে, আর নিজের ভাষা হল জ্ঞানার্জনের সবচেয়ে ভাল মাধ্যম। বাংলা উইকির তখন যাত্রা মাত্র শুরু। ২০০৫ সালের শেষের দিকে তখন সেখানে বড়জোর ৪০০ ভুক্তি ছিল, যার অধিকাংশই ফাঁকা। তার কারণ অবশ্য সহজেই বলা যায় – ইউনিকোডে বাংলা লেখা বা দেখাটা তখনও এতো সহজ ছিল না।
বাংলা উইকির এই দুর্দশা দেখে মনটা বেশ খারাপ হল। ঠিক করলাম, এই বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করার দিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাংলা উইকিতে তখন সম্পাদনা করার মত বলা যায় কেউই ছিল না। অর্ণব জাহিন একাই কাজ করছিলেন। আমি যোগ দিয়ে শুরু করলাম, কিন্তু অচিরেই বুঝলাম এর জন্য লাগবে বাংলাদেশে একটা উইকিপিডিয়ান কমিউনিটি তৈরি করা। দেশের কাজ, দেশের মানুষই করবে।
২০০৬-এর শুরুর দিকে আর থাকতে না পেরে এক বিশাল ওপেন লেটার লিখে ইন্টারনেটে যত বাংলা নিউজগ্রুপ বা ইয়াহু গ্রুপ আছে, সবখানে পোস্ট করলাম। সোশ্যাল মিডিয়া তখনও জনপ্রিয় হয়নি – সবার সাথে যোগাযোগের উপায় সেই মেইলিং লিস্টই। সেই বিশাল লেখাটার মোদ্দা কথা ছিল – ভাই ও বোনেরা, আপনারা দলে দলে বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করার কাজে যোগ দিন। কিছুটা কাজ হলো – পেয়ে গেলাম কয়েকজন বাংলাভাষী উইকিপিডিয়ানকে। কিন্তু তাঁদের অনেকেই দেশের বাইরে থাকা প্রবাসী। আমাদের দরকার দেশের ভিতরে থাকা মানুষদের উদ্বুদ্ধ করা। সমস্যার সমাধান হল সহজেই – আমার দেখা সবচেয়ে উদ্যমী ও সফল সংগঠক শ্রদ্ধেয় মুনির হাসান ভাই আর তাঁর বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কও তখন সদ্য যাত্রা শুরু করেছে। মুনির ভাইকে ধরলাম, উনাকে দিনরাত বিরক্ত করে চললাম। মুনির ভাই দারুণ একটা কাজ করলেন, ২০০৬ এর মার্চের শেষ দিকে বাংলা উইকিপিডিয়ার উপরে প্রথম আলোতে একটা চমৎকার লেখা লিখলেন।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বাংলা উইকিতে ঢুকে আকাশ থেকে পড়লাম। রাতারাতি অনেকজন নতুন সম্পাদক যোগ দিয়েছেন সেখানে। এরা সবাই বয়সে তরুণ, চরম উৎসাহ মনে, আর স্বপ্ন দেখার মত খোলা মনের মানুষ। বেলায়েত, রাজিবুল, মাহে আলম খান – এদের সবার সাথে পরিচয় ঘটলো। এখন আর আমরা অল্প কয়েকজন নই – ১০/১৫ জন মিলে কাজ শুরু হল। সেই সময়টাতে আমরা ছিলাম একটা পরিবারের মত। কলকাতার দ্বৈপায়ন চক্রবর্তী, সপ্তর্ষি মণ্ডল, বাংলাদেশের অর্ণব জাহিন, আর উপরে উল্লেখ করা কয়েকজন, আর আমি দিনরাত লেখালেখি শুরু করলাম। দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলোর প্রায় সবগুলোর অবস্থাই উইকিপিডিয়াতে তখন করুণ – কোনোটাতেই বেশি ভুক্তি নাই। অথচ অল্প কয়েক লাখ মানুষের বলা ইউরোপীয় কিছু ভাষায় তখন লাখ লাখ নিবন্ধ।
বয়স তখন আমাদের সবারই কম – তাই জিদ চেপে গেল আমাদের। প্রথম টার্গেট কী হবে? ঠিক করলাম, ৬ মাসের মধ্যে আমরা বাংলা উইকিতে ১০হাজার নিবন্ধ তৈরি করে ছাড়ব। আমার পিএইচডির কাজ শিকেয় উঠল, রাতদিন সময় পেলেই উইকিতে লিখি। বাকিরাও রাতদিন খাটছে। এভাবে এসে গেল অক্টোবর ২০০৬। আমাদের ছয় মাসের পরিশ্রম সফল হল – অক্টোবরের কোনো এক দিনে বাংলা উইকিতে এসে গেল ১০হাজার ভুক্তি। দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে পেলাম এই অর্জন।
দেশে গেলাম ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে। দেশের নানা জায়গার ছবি নাই, তাই ইচ্ছে ছিল অনেকগুলো ফটো তুলব। সাথে পেলাম রাজিবুল আর বেলায়েতকে – তাদের নিয়ে পুরানো ঢাকায় অনেকগুলো পুরাকীর্তির ছবি তুললাম একদিন সারা সকাল আর দুপুর ধরে। উইকিতে যোগ হল সেই ছবিগুলো – বাংলাদেশের কথা বাংলা আর ইংরেজি ভাষায় পৌঁছে গেল সারা বিশ্বের সবার কাছে।
স্বপ্নযাত্রার সেটা কেবলই শুরু।
বাংলা উইকিপিডিয়া সেই ২০০৬ সাল থেকে আজ বহুদূর এসেছে। বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে বিশাল আর সক্রিয় এক উইকিপিডিয়ান কমিউনিটি। সারা বিশ্বের উইকিপিডিয়ানদের মাঝেও স্থান করে নিয়েছেন বাংলা উইকিপিডিয়ার অনেক কর্মী তাঁদের নিবেদিতপ্রাণ পরিশ্রমের সুবাদে। এর মাঝে আমার জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে, পিএইচডি শেষ করে কর্মজীবনে ঢুকেছি, ব্যক্তিগত ও পেশাগত ব্যস্ততার কারণে প্রিয় উইকিপিডিয়াতে আর সেভাবে যাওয়া হয়না আগের মত। উইকিপিডিয়ার শুরুর দিকে আমার সঙ্গী হয়ে থাকা অনেকেই আজ উইকিপিডিয়াতে আমার মতোই নিষ্ক্রিয়। কিন্তু আমার চিন্তা নাই — বাংলা উইকিপিডিয়ার উদ্যমী কর্মীদের চরম উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখতে পাই দূর থেকে। যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা সেদিন যাত্রার শুরুটা করে দিয়েছিলাম, সেই যাত্রাটা এগিয়ে নিচ্ছেন একরাশ চরম স্বপ্নবাজ মানুষ। আজ ২০২০ সালে এসে আমরা দেখতে পাই, অনলাইনে বাংলা ভাষার জ্ঞানভাণ্ডারটা অনেকদূর সমৃদ্ধ হয়েছে। আর প্রচুর মানুষ বাংলা উইকিপিডিয়া পড়ছেন, সেখানকার তথ্যকে সফলভাবে ব্যবহার করছেন। আর যোগ হয়েছে বাংলাদেশের প্রচুর ছবি, তথ্য, উপাত্ত – ভার্চুয়াল জগতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা।
তাই বাংলা উইকিপিডিয়ার ১ লাখ নিবন্ধের বিশাল মাইলফলকটা যখন পার হলাম আমরা এই ডিসেম্বর ২০২০-এ, আমি তাতে অবাক হইনি, কারণ আমার বিশ্বাস ছিল, বাংলা উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়ের চরম উদ্যমী এই কর্মীদের হাতে সেটা সম্ভব হবেই। চৌদ্দ বছরে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ নিবন্ধে এসেছি আমরা, কিন্তু এটাই এই যাত্রার শেষ নয়, বরং এ হলো আমাদের স্বপ্নের পথে আরেকটু এগোনো মাত্র। আমার বিশ্বাস, ১ লাখ থেকে ১০ লাখে আমরা চলে যাব আরো কম সময়ে, কারণ আস্তে আস্তে আরো প্রচুর স্বপ্নবাজ মানুষ আমাদের এই অভিযাত্রায় যোগ দিচ্ছেন প্রতিদিন।
নিজের মায়ের ভাষা বলে কথা! বাংলা উইকিপিডিয়ার এই অভিযাত্রা এগিয়ে চলুক আরো বহুদূরে।
আমরা পেরেছি, আমরা পারি, আমরা পারবোই। অনলাইনে বাংলার বিকাশ ঘটবেই। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাক বাংলা – আমাদের মুখের ভাষা মায়ের ভাষা বাংলা।
জয় হোক বাংলা উইকিপিডিয়ার!
লেখক: রাগিব হাসান, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এর কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, উইকিপিডিয়ার প্রাক্তন প্রশাসক, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ-এর বর্তমান উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড সদস্য, লেখক এবং শিক্ষক.কম-এর প্রতিষ্ঠাতা।