
নিজ বসতবাড়িতে সুব্রত রায়
নরসিংদী জেলার নারায়ণপুর রাবেয়া মহাবিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান সুব্রত রায়ের বাংলা উইকিপিডিয়ার সাথে পরিচয় ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। সেসময় গুগল সার্চে বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধগুলো দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বাংলা উইকিপিডিয়াতে অবদান রাখা শুরু করেন। প্রথমদিকে বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য বইয়ে বর্ণিত বিষয়াবলী নিয়েই কাজ করেন।
ধীরে ধীরে তিনি ধর্ম, সাহিত্য, ব্যক্তিজীবনী, প্রকৃতি, সমাজ, রাজনীতি, খেলাধূলা ইত্যাদি হরেকরকম বিষয় নিয়ে নিবন্ধ লেখা শুরু করেন। উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়ে ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে পরিচিত এই অবদানকারী বাংলা উইকিপিডিয়াতে ক্রিকেট বিষয়ক ও ক্রিকেটারদের জীবনী সংশ্লিষ্ট অসংখ্য নিবন্ধ তৈরি করেছেন এবং এখনো করে চলেছেন। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা উইকিপিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি নিবন্ধ লিখে ‘উইকিপিডিয়া এশীয় দূত’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন, সুব্রত রায়। বাংলা উইকিপিডিয়াতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক ৪,৩৬৩টি নতুন নিবন্ধ তৈরি করেছেন সবার প্রিয় ‘সুব্রতদা’।
অভিজ্ঞদের তালিকার শীর্ষস্থানীয় এ উইকিপিডিয়ান এবারে মুখোমুখি হলেন উইকিবার্তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অংকন ঘোষ দস্তিদার।
উইকিবার্তা: প্রথমেই উইকিবার্তার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা। উইকিপিডিয়ার সাথে আপনার যুক্ত হওয়ার গল্পটা শুনতে চাই। শুরুটা কিভাবে হয়েছিল?
সুব্রত রায়: উইকিপিডিয়ার সকল ব্যবহারকারীসহ আপনাকেও শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। বোধহয়, ২০০৯ কিংবা ২০১০ সালের কোনো এক স্বর্ণালী দিনের কথা! কেউ যে বাংলা উইকিপিডিয়ায় সংশ্লিষ্ট হবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করবে এ ধরণের কোনো সুযোগ কিংবা ক্ষেত্র পাইনি, যা এখন রয়েছে। অভ্র কী-বোর্ড কিংবা রিদমিক কী-বোর্ডের নামও তখন শুনিনি। তবে, বিজয় কী-বোর্ডে ইউনিকোড ইন্টারফেস সংযুক্ত থাকায় বাংলায় ওয়ার্ড ডকুমেন্ট সেভ/সংরক্ষণ করার সুযোগ পেলাম যা ওয়েবের লেখার সাথে মিল খুঁজে পাই। ইন্টারনেটে মাঝে-মধ্যেই সার্চ বাটনে বাংলা উইকিপিডিয়ার নাম ভেসে আসতে থাকে। এখানেই বোধহয় বাংলা উইকিপিডিয়াকে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে নিয়ে আসার বা পরিচিতি ঘটানোর ক্ষেত্রে শুরুর দিকের উইকিপিডিয়ানদের সফলতা যা সন্দেহাতীতভাবে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয়। বিশ্বকোষ শব্দের সাথে ১৯৯০-এর দশকের সূচনালগ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে অধ্যয়নকালীন পরিচিত ছিলাম। মফস্বল এলাকায় অবস্থান করে ১৯৯৭ সাল থেকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মাধ্যমে কম্পিউটারের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছি। ফলে, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ভাসাভাসা দৃষ্টিতে বুঝতে পারি যে, এটি এমনই এক ধরণের প্লাটফর্ম যেখানে জ্ঞান আহরণসহ নিজস্ব জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটানো যায়, বাহ্যিক তথ্যের অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ইন্টারনেটের বিশাল জগতে অনুপ্রবেশ করা যেতে পারে। প্রথমবার নিবন্ধিত হলাম। কিন্তু, সফলকাম হইনি। দ্বিতীয়বার নিবন্ধিত হবার পর টের পেলাম, এর সাথে ই-মেইল অ্যাকাউন্টের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। সাড়া দিলাম আর কাজে লেগে গেলাম।
উইকিবার্তা: কিভাবে উইকি জগতের প্রতি আগ্রহ তৈরি হল?
সুব্রত রায়: ২০১০ সালের দিকে নিবন্ধের সংখ্যা বোধহয় ২০,০০০ ছিল। যেদিকে তাকাই, শুধু নাই আর নাই; অর্থাৎ লাল লিঙ্কের আধিপত্য বজায় ছিল। এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে, খুব বেশি মাত্রায় ছিল। এমনকি তথ্যছকেরও অস্তিত্ব ছিল না। যেদিকে হাত দেই, সেদিকেই নাই-নাই। শুরুতে, একটি বই থেকে লিখি। নতুন ব্যবহারকারীর কার্যকলাপ ও দৃষ্টিভঙ্গী পুরনোদের কাছে অবলীলায় ধরা পড়বেই। ফলে বেশ ঘন ঘন সতর্ক বার্তা পেতাম। তাসত্ত্বেও নিজের উপর অগাধ আস্থা আর বিশ্বাস রেখে লেগে থাকি। এছাড়াও, অধুনা অনিয়মিত হয়ে পড়া বেলায়েত ভাই তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ সহায়তার হাত প্রসারিত করেছেন উদার চিত্তে। তানভির ভাইও সহযোগিতার করার প্রয়াস চালিয়েছেন অবলীলাক্রমে। মাঝে-মধ্যেই বিভিন্ন ধরণের ভার্চুয়াল পদক উজ্জ্বীবনী শক্তি যোগাতো। শৈশবকাল অতিক্রমের পর যৌবনে এসে উইকিতে অবস্থান বলতে গেলে তৃতীয় জীবন হিসেবে ধরা দিয়েছে আমার কাছে।
শিক্ষাজীবনেই টাইপ-রাইটারের সাথে পরিচিত আর যুক্ত ছিলাম। ফলশ্রুতিতে, বাংলা কিংবা ইংরেজি মাধ্যমের কী-বোর্ডে সঠিকভাবে অঙ্গুলী সঞ্চালনে কিছুটা দক্ষতা রয়েছে যা সাধারণ ব্যবহারকারীদের তুলনায় বেশ পার্থক্য করে দিয়েছে। রচিত নিবন্ধের মানের প্রশ্নে তেমন কোনো বাঁধার মুখোমুখি হয়নি। অবাক নয়নে লক্ষ করলাম, যা জানি, তার চেয়েও অন্য ব্যবহারকারীদের অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার অনেক অনেক বেশি। রাগিব সাহেবের চপল দৃষ্টিভঙ্গী, বেলায়েত ভাইয়ের বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য, তানভির ভাইয়ের তারুণ্যতায় উজ্জীবিতপূর্ণ সহযোগিতামূলক মনোভাবসহ পরবর্তীকালে, আফতাব ও নাহিদ ভাইয়ের উদার দৃষ্টি এবং আশিক শাওন ও ফেরদৌস ভাইসহ অনেকের অন/অফ লাইনের সহযোগিতা অদ্যাবধি আগ্রহের সাথে জড়িত রেখেছে ওতপ্রোতভাবে যা অনেকাংশে উইকির প্রতি গভীর ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। প্রশাসক হিসেবে থাকলেও আমি একজন সাধারণ ব্যবহারকারী মাত্র। তারচেয়েও বড় কথা হলো – বাংলা উইকিপিডিয়ার শুভাকাঙ্ক্ষী আর শুভানুধ্যায়ী হিসেবেই নিজেকে দেখতে চাই।
উইকিবার্তা: উইকিপিডিয়া তথা উইকিমিডিয়া প্রকল্পে আপনি কোন বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণত কাজ করতে পছন্দ করেন?
সুব্রত রায়: উইকিপিডিয়াসহ এর বিভিন্ন প্রকল্প বিশেষ করে – উইকি সংকলন, উইকি উপাত্ত, উইকিকমন্স, উইকিভ্রমণ-সহ প্রকল্পে আগ্রহের উপর ভিত্তি করে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজে যুক্ত রয়েছি। অর্থাৎ, কম-বেশি সকল বিষয়েই সমান আগ্রহ রয়েছে। শুরুতে ধীরে ধীরে জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করতে শুরু করলাম, যদি তা আমার মনঃপুত হয়। চিন্তা করলাম নির্দিষ্ট একটি দিকে চলে যাবার। খেলাধুলা বিশেষ করে ক্রিকেটের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ রয়েছে। কৈশোরে বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের বিষয়ে জানতে চাইলেও তার কোনো উপযুক্ত ক্ষেত্র ছিল না। যুবক অবস্থায় উইকিপিডিয়ার সন্ধান পেলাম ও বাংলা ভাষায় জীবনীধর্মী রচনার মাধ্যমে আগ্রহ বাস্তবায়নসহ অন্যান্য আগ্রহী ব্যবহারকারীর চাহিদা মেটাতে সচেষ্ট হলাম। মূলত ক্রিকেটবিষয়ক জীবনী রচনাতেই সর্বাধিক আগ্রহ রয়েছে। চশমা ও ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করে কতোদিনে তা মোটামুটি একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবো, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। আসলে, সময়ই বলে দেয়, ব্যবহারকারী কোন দিকে যেতে পছন্দ করছেন। এছাড়াও, যার যেদিকে ভাল করার সম্ভাবনা আছে, তাকে সেদিকেই মনোনিবেশ ঘটানো প্রয়োজন বলে মনে করি। এর মাধ্যমেই নিজের দক্ষতাকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করা সম্ভব। উন্মুক্ত মাধ্যম হিসেবে সকলেরই উচিৎ – উপমহাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা ও ভাষাগত সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষিতে তার আগ্রহকে সম্মান জানানো। সৃষ্ট নিবন্ধগুলোর মান কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট গোত্রের ব্যবহারকারীর কাছেই মূল্যায়িত হয়। অন্য কাউকে নয় বা কাউকে সন্তুষ্ট করতে নয়। স্পষ্টতই টের পেয়েছি, বিশাল এ জগতে কারো একার পক্ষে উইকি সমৃদ্ধি করা মোটেই সম্ভব নয়। এর জন্যে দলগত, ব্যক্তিগত বিষয়গুলো জড়িয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সমস্যা যেমন: কারিগরী দিক, মানসিক দিক, অর্থনৈতিক দিক, শিক্ষাগত দিক ইত্যাদি রয়েছে।
উইকিবার্তা: পূর্বের কোনো কাঙ্ক্ষিত উইকিপ্রকল্প বাস্তবায়নে কি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন? সম্মুখীন হলে কী ধরণের বাধা? কিভাবে সমস্যার মোকাবেলা করেছেন?
সুব্রত রায়: না, তেমন বাঁধার মুখোমুখি হয়নি। এখানকার পরিবেশ যথেষ্ট উদার অর্থাৎ সংকুচিত নয়। নতুন কিংবা পুরনো বাংলাভাষী ব্যবহারকারীদের উচিৎ বাংলা ভাষার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করা, গ্রহণযোগ্যতার পরিবেশ নিয়ে আসা। ভিন্ন ভাষায় না গিয়ে বাংলা উইকিপিডিয়ায় অবস্থান করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কাজ করলে আলোচনা-সমালোচনা হবেই বা থাকবেই। আর কাজ না করলে কে, কাকে চিনবে; উইকিতে অবস্থান না করলে হয়তোবা রত্নতুল্য প্রযুক্তিবিদদের সন্ধানই পেতাম না বলে বিশ্বাস করি। বিদ্যুৎ ও কম্পিউটার খানিকটা পিছিয়ে দিয়েছে বলা যায়। এছাড়াও, কিছুটা মন কষাকষি ও সন্তানের চিকিৎসার্থে ভারত গমনে সময়ের অপচয় করেছি বলে মনে করি। নয়তো, আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম। অর্থাৎ, খুব কম সময়ই উইকি থেকে বিচ্ছিন্ন থেকেছি। কিছু ক্ষেত্রে আলাপ পাতা ব্যবহার না করেই পাতা স্থানান্তরের প্রবণতা অভিজ্ঞদের মাঝেও অদ্যাবধি দেখা যায়। অর্থাৎ, আলাপ পাতার সঠিক ব্যবহার করা হয় না। তবে, কিছু অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের ঘটনা মানসিকভাবে অন্য ব্যবহারকারীদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে যা নিষ্ঠাবান বা আদর্শবান ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে কোনোক্রমেই কাম্য হতে পারে না এবং তা বিশ্বাস করতে এখনও বেশ কষ্ট হয়। কেননা, টাকাই জীবনের সবকিছু নয়। কিছু ক্ষেত্রে ‘একার পক্ষে কি শেষ করা সম্ভব’ বা ’ক্রিকেটবিষয়ক লেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকা মানায় না’ – এ জাতীয় বক্তব্যও হতভম্ব অবস্থায় শ্রবণ করতে হয়েছে। নিজে তো করবেনই না, অপরকেও দাবিয়ে রাখার অপপ্রয়াস কিছু ক্ষেত্রে পেয়েছি যা অনেকটাই আত্মঘাতিমূলক চিন্তাধারার সমতুল্য বলে মনে করি।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে যখন এক মনে উইকি বিকাশে নিজেকে ব্যস্ত রাখছি, তখন হয়তোবা কিছুসংখ্যক নিয়মিত ব্যবহারকারী অযথা সময় নষ্ট করছেন ফেসবুকের ন্যায় সামাজিক মাধ্যমের মোহময় দুনিয়ায় যা বেশ হতাশাদায়ক, কষ্টদায়ক। অর্থাৎ, জ্ঞানকে গড্ডালিকাপ্রবাহে ভাসিয়ে অমূল্য সময় নষ্ট করছেন তারা।
একটি সময় ছিল যখন মনে হতো – আমিই হয়তোবা একমাত্র ব্যবহারকারী কিংবা একই ব্যক্তি হয়তোবা ভিন্ন ভিন্ন নামে উইকিতে রয়েছেন। অর্থাৎ, একেবারেই ফাঁকা পরিবেশ ছিল। এমনও হতো যে, দিনে মাত্র একশো বা দুইশো সম্পাদনা হয়েছে। পরবর্তীতে কয়েকটি কর্মশালা ও সম্মেলনে যোগদানের ফলে এ ধারণা দূর হয় ও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এতদূর অগ্রসর হয়েছে বলে জানতে পারি। সম্পাদনা দ্বন্দ্ব বা অন্য ব্যবহারকারী কর্তৃক আকস্মিক সম্পাদনার মাধ্যমে অজানা সঙ্কেত পেতাম যে, নিবন্ধে আর বাইট বাড়িয়ে বা সময় খরচ করে লাভ নেই বা আর নিবন্ধ সম্প্রসারণের দরকার নেই। এখনো মাঝে-মধ্যে নতুন ব্যবহারকারী সম্পাদনা দ্বন্দ্বের মাধ্যমে কাজের গতিকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাবার ব্যর্থ প্রয়াস চালান কিংবা, আলাপ পাতায় বার্তা রাখার মাধ্যমে নিবন্ধ থেকে মনযোগ ঘুরিয়ে নেয়া ইত্যাদি বাঁধার সম্মুখীন মাঝে-মধ্যেই পেয়ে থাকি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যখন এক মনে উইকি বিকাশে নিজেকে ব্যস্ত রাখছি, তখন হয়তোবা কিছুসংখ্যক নিয়মিত ব্যবহারকারী অযথা সময় নষ্ট করছেন ফেসবুকের ন্যায় সামাজিক মাধ্যমের মোহময় দুনিয়ায় যা বেশ হতাশাদায়ক, কষ্টদায়ক। অর্থাৎ, জ্ঞানকে গড্ডালিকাপ্রবাহে ভাসিয়ে অমূল্য সময় নষ্ট করছেন তারা। এখানে ভূমিকা রাখলে তা হয়তোবা স্থায়ীভাবে টিকে থাকবে, স্মরণ করে দেবে তাদের জ্ঞানের ধারাকে, সমৃদ্ধ করবে বাংলা ভাষাকে, অন্যকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
সমস্যা মোকাবেলায় নিজস্ব চিন্তাধারা, সদা সহায়তাকারী রত্নসম ব্যবহারকারীর সাথে অন/অফ লাইনে শরণাপন্ন হয়েছি বা হচ্ছি এখনো। সর্বদাই বিশ্বাস করি, কেউ না কেউ নজর রাখছেন কিংবা সহায়তার হাত প্রশস্থ করতে এগিয়ে আছেন অবলীলাক্রমে। অর্থাৎ, প্রায় সকল ব্যবহারকারীই একে-অপরকে যে-যার সাধ্যমত সহায়তা করতে প্রস্তুত। কোনো ভুল হলে, তা সংশোধন করে দিবেনই সময়ান্তরে তা তার যতটুকু জানা আছে। অনেকক্ষেত্রে রাগ সংযত রাখার চেষ্টা করি কিংবা মিষ্ট ভাষায় তার কাছে এর মানে কী বা কেন করা হলো তা জানতে চাই বা জানাতে চাই। কিংবা অন্যদিকে চলে যাই। কিন্তু, অভিজ্ঞদের জানা প্রয়োজন যে, এ সকল কাজের মাধ্যমে কেবলমাত্র সময়েরই অপচয় হবার সম্ভাবনা বেশি। আর, সম্মিলিত কাজ হলেও একজন নিবন্ধ রচয়িতার উচিৎ হবে যতটুকু সম্ভব একটি নিবন্ধ শেষ করে পরবর্তী নিবন্ধে অগ্রসর হওয়ার। কেননা, ভাষাগত সীমাবদ্ধতা আর আগ্রহের উপর ভিত্তি করে সাধারণত খুব কমক্ষেত্রেই সমমনা ব্যবহারকারীর সন্ধান পাওয়া যায়। উপমহাদেশের ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটসহ ভাষাগত বিষয়, মানসিক দৃষ্টিভঙ্গী, আর্থসামাজিক অবস্থাসহ বহুবিধ বিষয় বোধহয় এর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
উইকিবার্তা: বাংলা উইকির উন্নতিকল্পে এই মুহূর্তেই প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলতে বললে আপনি কোন পদক্ষেপের কথা বলবেন?
সুব্রত রায়: ইংরেজি ও বাংলা উইকির নিবন্ধ সংখ্যা যথাক্রমে ষাট লক্ষ আর প্রায় বিরাশি হাজার (সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় বাংলা উইকির নিবন্ধ সংখ্যা বিরাশি হাজার ছিল)। নিয়মিত ব্যবহারকারীরা যদি দৈনিক একটি করে হলেও নিবন্ধ রচনায় অগ্রসর হতেন, তবে বেশ কয়েক বছর পূর্বেই দুই লক্ষের কোটা অতিক্রম হয়ে যেতো। এছাড়াও, নতুন ব্যবহারকারীরাও পুরনো অভিজ্ঞ ব্যবহারকারী ও প্রশাসকদের কাছ থেকে কিছু জ্ঞান অর্জন করতে পারতো বা শিখতো। নিবন্ধ সংখ্যা বৃদ্ধির বিকল্প অন্য কোনো কিছু দিয়ে হতে পারে না বলে বিশ্বাস করি। নিবন্ধ যতো বৃদ্ধি পাবে, পাঠকসহ ব্যবহারকারীর সংখ্যাও ততো বৃদ্ধি পাবে, কলরবে ভরপুর হবে। তবে, মানের বিষয়ে আপোষ করা চলবে না। তথ্যসূত্রের বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হওয়া প্রয়োজন। তবে, এর জন্যে বিভিন্ন প্রকল্পে সদস্যভুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত করা যায়। অর্থাৎ, প্রকল্পের সদস্যরাই যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে নিবন্ধ গ্রহণ/অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানে নিয়মিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা একেবারেই হাতে-গোণা। বিতর্কিত বিষয়গুলো সরাসরি অপসারণ প্রস্তাবনায় নেয়া যেতে পারে। সেলক্ষ্যে, প্রশাসকদেরকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। অভিজ্ঞ ব্যবহারকারী সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়মিতভাবে বিজ্ঞাপন/অনলাইন/মোবাইল/ইমেইলে ব্যক্তিগতভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতা করার পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে।

বাংলা উইকিপিডিয়ার দশম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মেলনে সুব্রত রায় (ছবি: অংকন, সিসি-বাই-এসএ ৪.০)
উইকিবার্তা: সহস্রাধিক নিবন্ধের প্রণেতা আপনি। যাত্রাটা দীর্ঘ ছিল। এখন পিছনে তাকালে কেমন বোধ হয়? যাত্রাটা কেমন ছিল?
সুব্রত রায়: পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, নিজেকে শুভানুধ্যায়ী হিসেবেই আজীবন উইকিপিডিয়ায় দেখতে চাই। ২০২০-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি তারিখের হিসেবে ৪,৩১৪টি নিবন্ধ রচনা করেছি যা বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধ সংখ্যার প্রায় ৫%-এর অধিক। এ প্রক্রিয়াটি অব্যাহত রয়েছে। অর্থাৎ, শারীরিক সুস্থতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে আমৃত্যু স্বেচ্ছায় কাজ করে যেতে চাই। এছাড়াও, প্রায় ৬৮হাজার সম্পাদনা করেছি। রেকর্ড করা হয় ভাঙার জন্যে। অবশ্য, রেকর্ড গড়ার জন্যে উইকিতে সম্পৃক্ত হইনি। আন্তরিকভাবে আশাবাদী যে, এজাতীয় রেকর্ডগুলো অন্য কেউ টপকিয়ে যাবেন অবলীলাক্রমে। সেদিনের প্রত্যাশায় রয়েছি আমি। নিবন্ধ কয়টি করেছি সেদিকে তাকাইনি। আর, মনে রাখতে হবে কোনো নিবন্ধই কিন্তু ফেলনা বা গুরুত্বহীন নয়। অর্থাৎ, তালিকাভিত্তিক নিবন্ধ, টেমপ্লেট থেকে শুরু করে উইকি সম্পর্কীয় যেকোনো বিষয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি নিবন্ধ থেকে অন্যান্য নিবন্ধের সংযোগসহ নিবন্ধ তৈরি হতে পারে। আর তালিকাভিত্তিক নিবন্ধগুলো থেকে কিন্তু আরও অনেক বড় কিছু প্রাপ্তি অপেক্ষা করছে। যেমন: উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার। তালিকাভিত্তিক এ নিবন্ধটি প্রায় ছয়শত নিবন্ধ তৈরি করতে সহায়তা করেছে। বরঞ্চ অন্য ব্যবহারকারীরা আমাকে নিবন্ধ সংখ্যা সম্পর্কে সম্যক অবগত করিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন, সহযোগিতা করে চলেছেন যা সত্যিই আশাপ্রদ ও উল্লেখযোগ্য দিক। দীর্ঘ এ যাত্রাপথে সকলের সহযোগিতা না পেলে তা মোটেই সম্ভবপর হত না। পেছনে ফিরে যদি তাকাই, তাহলে বেশ বিস্ময়কর মনে হয়। এ-ও কি সম্ভব? এতোগুলো নিবন্ধ সৃষ্টি হলো কিভাবে? এক সময়তো লাল লিঙ্কের ছড়াছড়ি ছিল। এখনো লাল লিঙ্ক রয়েছে, তবে তা কিছুটা কম।
পেছনে ফিরে যদি তাকাই, তাহলে বেশ বিস্ময়কর মনে হয়। এ-ও কি সম্ভব? এতোগুলো নিবন্ধ সৃষ্টি হলো কিভাবে?
ভালো-মন্দ মিলিয়ে প্রায় দশ বছরের দীর্ঘ যাত্রাপথে যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন, তাদের প্রত্যেককেই অশেষ ধন্যবাদ জানাই। কিছুটা অম্লমধুর এ পথপরিক্রমায় রাগ-অনুরাগ, জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ, জ্ঞান লাভ, আবদার-অন্যায় আবদার, আনন্দ-বেদনা, ভালোবাসা-ঘৃণা, ভালো-মন্দ, পুরস্কার ও বন্ধু প্রাপ্তি ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়াবলী জড়িত। তবে, প্রযুক্তির বিকাশে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেরই একযোগে অংশগ্রহণ একান্ত কাম্য। একটি কথা না বললেই নয়, শিক্ষার আদর্শ মাধ্যম ও উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে এখানে সঙ্কীর্ণতা, বিরূপ চিন্তাধারা ও ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গীর কোনো স্থান নেই, ঠাঁই নেই বলেই মনে হয়। এ ধরণের মানসিকতাও কারো কাছ থেকে কোনোক্রমেই কাম্য নয়। কেননা, এ বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞানের আদর্শ সম্মিলন ক্ষেত্র হিসেবে উইকিপিডিয়া নির্দিষ্ট কোনো দেশের মধ্যে অবস্থান করছে না; এটি বৈশ্বিক ও সকলের জন্যে উন্মুক্ত।
উইকিবার্তা: বাংলা উইকি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সুব্রত রায়: বাংলা উইকির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল। ব্যক্তিগতভাবে জ্ঞানী-গুণীজনদের মাঝে এর প্রচার করে থাকি। অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাই। উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হবার স্বপ্ন দেখি। যতটুকু সম্ভব ও করণীয় ঠিক ততটুকুই করে যাচ্ছে। সাংবার্ষিক কিংবা দ্বি-বার্ষিকভিত্তিতে নিয়মিত ব্যবহারকারীদেরকে একসাথে নিয়মতিভাবে বসার বিষয়ের চিন্তাধারা কর্তৃপক্ষের অবগত থাকা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করি।
উইকিবার্তা: বৈশ্বিক উইকিতে বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে আশা/নিরাশার কিছু দিক সম্পর্কে জানান আমাদের।
সুব্রত রায়: যদিও আমি বাংলাদেশী, তবুও এর ক্ষেত্র কিন্তু ভিন্ন অর্থাৎ বিশ্বময়। শুধুমাত্র নির্দিষ্ট একদিকে না তাকিয়ে সকল দিকে অগ্রসর হওয়া উচিৎ। গভীরতার দিক দিয়ে বাংলা উইকিপিডিয়ার অবস্থান বেশ উঁচুতে থাকলেও সংখ্যার দিক দিয়ে একেবারেই নগণ্য। যতটুকু সম্ভব প্রত্যেকেরই উচিৎ হবে দৈনিক এক বা একাধিক নিবন্ধ প্রণয়নে অগ্রসর হওয়া। বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ ও একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়লে আগামী ২০২২ সালের মধ্যেই হয়তোবা দুই লক্ষ নিবন্ধের মাইলফলক অর্জিত হবে। বেশকিছু ক্ষেত্রে বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের মান অন্য উইকির মানের চেয়েও বেশ ঊর্ধ্বে। আর, ভবিষ্যৎ প্রভাবের কথা চিন্তা করে ইংরেজি উইকির সাথে সমন্বয় করে চলা উচিৎ। তবে, কিছু ক্ষেত্রে এর ভিন্নতাও ঘটতে পারে। আর জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পাবার ফলে সুফল লাভের পাশাপাশি এর অপব্যবহার বাড়ছে। ফলে তা কঠোরহস্তে দমন করা উচিৎ।
উইকিবার্তা: অবদানের মাধ্যমে আপনি শুধু নতুনই নয়, অনেক পুরাতন অবদানকারীদের নিকটও অনুপ্রেরণা। তাদের সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
সুব্রত রায়: প্রত্যেক ব্যবহারকারীকেই রত্নসম প্রযুক্তিবিদ হিসেবে দেখা উচিৎ, সহযোগিতা করা উচিৎ, আগ্রহকে মূল্যায়ন করা উচিৎ। কেননা, সফট কপি হিসেবে নিবন্ধ রচনায় কম-বেশি তাঁরাই ভূমিকা রাখছেন যাঁরা শিক্ষিত। পূর্বে বহু বাঁধা-বিপত্তি ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল, ট্যাব ইত্যাদি বিচিত্র সকল মাধ্যমে ইউনিকোডে অভ্র/রিদমিকসহ বিভিন্ন কী-বোর্ডের মাধ্যমে বাংলা লেখা যায়। মোবাইলে ডব্লিউপিএস কিংবা গুগল ডকস-সহ আরও বিভিন্ন ধরণের বাংলা অ্যাপ রয়েছে। এছাড়াও, অফলাইনে তথ্য সুবিধা লাভের জন্যে কিউইক্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং, প্রত্যেকেই যদি খানিকটা সময় ব্যয় করে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণের মাধ্যমে আধুনিক জগতে প্রবেশ করে তাঁদের মূল্যবান জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটান তাহলে বাংলা উইকিপিডিয়ার দ্রুত সমৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটবে নিঃসন্দেহে বলা যায়। আদর্শ উইকিপিডিয়ান হবার জন্যে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতাসহ সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার করাও অত্যাবশ্যক। আর, সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে জ্ঞানের পরিস্ফুটন অবলীলাক্রমেই চলে আসবে, মানসিক স্থবিরতাও ক্রমশ বিলীন হবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আর, বাংলা ভাষার প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্নে সকলেরই একই অবস্থানে থাকা উচিৎ। মনে রাখা উচিৎ যে, কোনো ভিন্ন ভাষার ব্যক্তি কিন্তু বাংলা ভাষায় তার মনের ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারবেন না। কেবলমাত্র বাংলাভাষী ব্যবহারকারীর পক্ষেই মনের ভাব পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটিয়ে তুলে বাংলা উইকিপিডিয়াকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব।
উইকিবার্তা: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সুব্রত রায়: আপনাকেও ধন্যবাদ।