২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল বাংলা উইকিপিডিয়ার প্রধান পাতা।

ইংরেজি উইকিপিডিয়ার সাথে আমার পরিচয় ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে, ইংরেজি উইকিপিডিয়ার বয়সও তখন মাত্র বছর দুয়েক। কিন্তু সেই সময়টায় বাংলা উইকিপিডিয়ার অস্তিত্ব ছিলনা। এর কারণ একাধিক — সবচেয়ে বড় কারণ ছিল বাংলা ইউনিকোডের প্রচলন মাত্র শুরু হয়েছে, এবং অধিকাংশ কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেমেই এর সাপোর্ট ছিলনা, বাংলা দেখার জন্য অনেক কনফিগারেশন পাল্টাতে হতো। আর তার উপরে ইউনিকোডে বাংলা লেখার ব্যাপারটাও খুব নতুন।

পুরো ইন্টারনেটে ইউনিকোড বাংলায় বানানো ওয়েবসাইট ছিলো হাতেগোণা। সেজন্য প্রথম দিকের সময়টাতে বাংলা উইকিপিডিয়ার উপরে সেভাবে কাজ হয়নি, বাংলা উইকির শুরুই হয় বছর কয়েক পরে। ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে আমি তখন নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের সবকিছু নিয়ে লিখে চলেছি, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে সেখানে প্রশাসকের দায়িত্বও পেয়েছি।

এর মাঝে বাংলা উইকিপিডিয়ার কাজ শুরু হয়েছে, কিন্তু কাজ করার মতো কর্মীর বেশ অভাব ছিল। ফলে বাংলা উইকিপিডিয়াতে বলতে গেলে তেমন কোনো তথ্যই পাওয়া যেত না। বাংলাদেশের অনেকেই ইন্টারনেটে সক্রিয় থাকলেও বাংলা লেখার অনভ্যস্ততা বা বাংলা ইউনিকোডের কারিগরি সমস্যার ফলে বাংলা উইকিপিডিয়া শুরু হয়েও অনেকটা আটকেই ছিল এক জায়গায়।

পুরা ব্যাপারটা পাল্টে যায় ২০০৬-এর শুরুর দিকে। ঠিক সেই সময়টাতে বাংলা ব্লগিং এর জগত ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করছে, ফলে প্রচুর মানুষ কম্পিউটারে বাংলা লেখালেখি করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন, ব্লগিং করতে গিয়ে বাংলায় অনেক কিছু লিখছেন ইন্টারনেটে। আর একই সাথে বাংলা ইউনিকোডের কারিগরি সমস্যাগুলাও ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে।

অভ্র’র মতো দারুণ এবং সহজে শেখা যায় এমন বাংলা ফোনেটিক টাইপিং টুল এসে পড়েছে সবার হাতের নাগালে। এই কয়েকটা ব্যাপার একসাথে ঘটায় ধীরে ধীরে বাংলা উইকিপিডিয়ার অবস্থাটা পাল্টে গেল। আমি ছাড়াও গুটিকয়েক স্বেচ্ছাসেবী উইকিপিডিয়ান ধীরে ধীরে হাত লাগালেন। কিন্তু একটা বিশ্বকোষ দাঁড় করাতে আসলে অনেক অনেক মানুষের কাজ করার দরকার।

আরও পড়ুন: কেন দরকার বাংলা উইকিপিডিয়া?

সমস্যাটা হলো, উইকিপিডিয়া কী, সেটাই অনেকের সেসময় জানা ছিল না, আর ইন্টারনেটের একটা সাইট পাঠ করার পাশাপাশি সম্পাদনা করে পাল্টে দেয়া যাবে, সেটাও ছিল অনেকটা অভাবনীয় একটা ব্যাপার। সেজন্য নানা মাধ্যমে প্রচুর মানুষের সাথে যোগাযোগ করলাম, তাঁদের উইকিপিডিয়ায় যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম।

সে সময়টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক এতোটা জনপ্রিয় হয়নি, ফলে শ’খানেক ইমেইলে আর নানা মেইলিং লিস্টে আহবান জানানোই ছিল একমাত্র উপায়। ২০০৬-এর মার্চে বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান ভাই বাংলা উইকিপিডিয়া নিয়ে দৈনিক প্রথম আলোতে একটি নিবন্ধ লিখলেন — জনমানুষের বিশ্বকোষের ধারণাটা বাংলা ভাষার গণমাধ্যমে প্রচারিত হলো প্রথমবারের মতো।

রাতারাতি প্রচুর মানুষ, বিশেষ করে প্রচুর তরুণ/কিশোর/শিক্ষার্থী এগিয়ে এলেন। বাংলা উইকিপিডিয়াতে তখন ভুক্তি বা এন্ট্রি মাত্র ৫০০টির মতো, তাও প্রায় সবগুলোতেই একটি বাক্যের বেশি নেই। কিন্তু উৎসাহী কর্মীদের আগ্রহের কমতি নেই, তাঁরা বিপুল উদ্যমে কাজ শুরু করলেন।

বিশ্বকোষে লেখাটা আসলে ব্লগ বা অন্য কিছু লেখার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। লিখতে হয় অনেকটা আনুষ্ঠানিক কেতায় (ফর্মাল টোনে), আর প্রতিটি লেখার তথ্যসূত্র দিতে হয়, সত্যতা যাচাই করতে হয়। সেটা হাতে ধরে আমরা অভিজ্ঞ কয়েকজন অন্যদের শেখালাম, ধীরে ধীরে জনা দশেকের মতো নিবেদিতপ্রাণ কর্মী পেলাম। শুরু হলো বাংলা উইকিপিডিয়ার যাত্রাটা।

প্রথম দিকে আমাদের লক্ষ্য ছিল কী করে নিবন্ধের সংখ্যা বাড়ানো যায়। প্রায় ২৫কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলায় তখন পুরো ইন্টারনেটেই কোনো তথ্যকোষ তো দূরের কথা, বাংলা ভাষার ওয়েবসাইটের সংখ্যাই খুব অল্প ছিল। ফলে তথ্য যোগ করতে হত বাংলা বইপত্র থেকে ধীরে ধীরে টাইপ করে, কিংবা ইংরেজি কোনো তথ্যকোষ থেকে অনুবাদ করে। কিন্তু তাতে থেমে থাকেননি কেউ, মাত্র ৬ মাসের মাথায় ২০০৬-এর অক্টোবরে আমরা নিবন্ধের সংখ্যা বাড়িয়ে ১০হাজারে উন্নীত করি।

দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষার উইকিপিডিয়াতেই প্রথম ১০ হাজার ভুক্তির মাইলফলকে পৌঁছাই আমরা। কিন্তু এর পরেপরেই আমরা বাংলা উইকিপিডিয়ানরা মিলে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেই — নিবন্ধের সংখ্যা নয়, বরং আমরা নজর দিব গুণগত মানের দিকে। ফলে এর পরে আমরা নিবন্ধের সংখ্যা বাড়াবার বদলে নিবন্ধগুলাকে আরো সমৃদ্ধ করার দিকে মন দেই।

আমাদের পরে শুরু হওয়া অনেক উইকিপিডিয়া যেমন হিন্দি, মরাঠি এদের ভুক্তির সংখ্যা এখন আমাদের চেয়ে বেশি, কিন্তু বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধের গড় মান পুরো দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, পুরো দুনিয়াতেই অনেক ভাষার উইকিপিডিয়ার চেয়ে অনেক ভালো।

লেখালেখির পাশাপাশি আমরা সেসময় আরেকটা কাজ শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের নানা জায়গা, নানা গুণীজন, আমাদের সংস্কৃতি, ভবন, স্থাপনা, এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুর ছবিই মুক্ত লাইসেন্সে পাওয়া যেত না। ফলে উইকিপিডিয়ার অনেক নিবন্ধে চাইলেও আমরা ছবি দিতে পারতাম না।

তবে উইকিপিডিয়াতে ছবি আপলোডের সময় ছবির লাইসেন্স এবং কপিরাইটের ব্যাপারটায় খুব সাবধানতা বজায় রাখতে হয়। তাই আমরা বাংলাদেশের ছবি জোগাড়ের জন্য বেশ বড় মাপের ক্যাম্পেইন করি, ফলে অল্প দিনেই বাংলাদেশের অনেক কিছুর ছবি জোগাড় হয়ে যায়।

তবে সৃজনী সাধারণ বা ক্রিয়েটিভ কমন্সের মতো মুক্ত লাইসেন্সে ছবি পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। শহীদ মিনারের অনেক ছবি অনলাইনে পেলেও সেগুলার কপিরাইট কেউ ছাড়তে রাজি হননি, কিন্তু এক জার্মান স্কলার কার্ল রোহেলের তোলা একটি ছবির অনুমতি চাওয়া মাত্র তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান, সেই ছবিটিই স্থান পায় শহীদ মিনারের নিবন্ধে।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে পথচলা শুরু করা ছোট্ট এক বিশ্বকোষ যেভাবে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা দেখতে পারা অনেক আনন্দের। আরো বেশি আনন্দ পাই, যখন মনে করি এই আন্দোলনের আমিও একজন। অনেক অনেক শুভকামনা সকল উইকিপিডিয়ানের প্রতি।

লেখক: রাগিব হাসান, কম্পিউটার বিজ্ঞানী, ইউনিভার্সিটি অব আলাবামা অ্যাট বার্মিংহাম-এর কম্পিউটার বিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক, উইকিপিডিয়ার প্রাক্তন প্রশাসক, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ-এর বর্তমান উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা বোর্ড সদস্য, লেখক এবং শিক্ষক.কম-এর প্রতিষ্ঠাতা।

উইকিবার্তা
Translate »
Share This