
উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ক্যাথরিন মা’র। ছবি: ভিক্টর গ্রিগাস/সিসি-বাই-এসএ ৩.০
ক্যাথরিন মা’র অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়াসহ অনুরূপ সহপ্রকল্প পরিচালনাকারী মূল প্রতিষ্ঠান উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি এ পদে নিযুক্ত হন। এর আগে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার উচ্চপদে আসীন ছিলেন ক্যাথরিন।
আগস্ট মাসে সুইডেনের স্টকহোমে আয়োজিত উইকিম্যানিয়া সম্মেলনে উইকিবার্তায় একটি সাক্ষাৎকারের জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হল। সদা হাস্যোজ্বল ক্যাথরিন তৎক্ষণাৎ সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। অবশেষে ১৮ আগস্ট মধ্যাহ্নে কথা হল তাঁর সাথে। জানালেন উইকিমিডিয়া নিয়ে তাঁর চিন্তা, এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বাংলাদেশে সফরের আন্তরিক ইচ্ছাও ব্যক্ত করলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অংকন ঘোষ দস্তিদার।
[Read this post in English language]
উইকিবার্তা: প্রথমেই উইকিবার্তার সাথে সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হওয়ায় ধন্যবাদ জানাই।
ক্যাথরিন মা’র: আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ!
উইকিবার্তা: আপনি বিশ্বব্যাংক, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট, ইউনিসেফ প্রভৃতি জনপ্রিয় সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। নীতিগত বিষয়ের দিকে দিয়ে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের সাথে এই সংস্থাগুলোর পার্থক্য কী?
ক্যাথরিন মা’র: চমৎকার প্রশ্ন! এই সংস্থাগুলোতে আমি প্রায় একইরকম বিষয় নিয়ে কাজ করেছি, কারণ সেখানেও বৈশ্বিক ব্যাপার নিয়েই কাজ করতে হত। সেখানে দেশ বা সম্প্রদায়ভিত্তিক ভিন্ন ধরণের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমরা কাজ করতাম। তবে আমার কাছে প্রাথমিক পার্থক্য হল এই যে, এসব সংস্থায় আপনি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে একই তালে কাজ করবেন না। এই সংস্থাগুলোর উদ্দেশ্যও মহৎ, তাঁরা শিশুমৃত্যুর হার কমাতে চাইছে, মানুষ যেন সহজে শিক্ষাসুবিধা পায় তা নিয়ে কাজ করছে, স্বাস্থ্য বা গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কাজ করছে। বড় পার্থক্য হল, এই সংস্থাগুলোতে বেতনভুক্ত কর্মকর্তারা থাকেন যাঁরা নিজ সম্প্রদায় আর দেশে কাজ করেন।
অন্যদিকে উইকিমিডিয়াতে সম্প্রদায়ই ঠিক করে তাঁদের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কি শিক্ষার দিকে মনোযোগ দেব, না শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির দিকে? আমরা কি সাংস্কৃতিক অখণ্ডতা নিয়ে আলোচনা করব, না ঐতিহ্য নিয়ে? প্রতিটি উইকিমিডিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব পছন্দসই বিষয় রয়েছে, তাঁরাই ঠিক করেন তাঁদের ভাষাগত সম্প্রদায়, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রের জন্য কী গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে উইকির সম্পূর্ণ আন্দোলন গুছিয়ে উঠে, এর কারণ আন্দোলনের পন্থাই সম্প্রদায়কে বলে দেয় কী নিয়ে কাজ করা উচিত। ব্যাপারটা এরকম যে, আপনি মডেলটা তৈরি করেন এবং পরে এটা সম্পূর্ণ বদলে যায়।

বাংলা উইকিপিডিয়া অবদানকারীদের সাথে ক্যাথরিন মা’র (২০১৬)। ছবি: সিসি-বাই-এসএ ৩.০
উইকিবার্তা: ইন্টারনেট খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে, সেই সাথে বদলাচ্ছে মানুষের পছন্দও। আপনার দৃষ্টিতে কী মনে হয়, উইকিমিডিয়ার ওয়েবসাইট কী সেই তালে বদলাতে পারছে?
ক্যাথরিন মা’র: আবারও অসাধারণ প্রশ্ন। আমার মনে হয় উইকিপিডিয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন হয়েছে মোবাইলে। আপনি যদি কম্পিউটার দিয়ে উইকিমিডিয়া বা উইকিপিডিয়ার ওয়েবসাইটগুলো দেখেন তাহলে ৫বছর আগেও যা ছিল তার সাথে বেশ সামঞ্জস্য খুঁজে পাবেন। এটা খুব একটা বদলায়নি। সম্পাদনার সফ্টওয়্যার আগের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে কিন্তু ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতার পরিবর্তন তেমনটা হয়নি। কিন্তু মোবাইলের ক্ষেত্রে…আপনি যদি অ্যাপ বা অ্যান্ড্রয়ডে ওয়েব ভার্সন ব্যবহার করে থাকেন, তবে দেখবেন উইকিপিডিয়াও বাকি ইন্টারনেটের মতই মনে হচ্ছে। তথ্য আহরণের দিক দিয়ে পরিবর্তনশীল পৃথিবীর কথা মাথায় রেখেই উইকিপিডিয়ার নকশা করা হয়েছে।
একটি বিষয় নিয়ে এবছর উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন গবেষণা করেছে সেটি হল উইকিমিডিয়ার পরিবেশের সম্পূর্ণ বাইরে গিয়ে নতুন এক পরিবেশে উইকিপিডিয়া পড়লে তার ফলাফল কেমন হয় – যা কিনা দেখতে বা পড়তে উইকিপিডিয়ার মত নয়, কিন্তু তা উইকিপিডিয়াই। আমি নিশ্চিত নই, বাংলাদেশের নিজেদের জাতীয় ক্রিকেট দল কি বিশ্বকাপে অংশ নেয়?
উইকিবার্তা: জ্বি!
ক্যাথরিন মা’র: চমৎকার! এবছরের (২০১৯) ক্রিকেট বিশ্বকাপে উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন উইকিপিডিয়া থেকে তথ্য নিয়ে একটি মাইক্রোসাইট তৈরি করেছিল। এটি দেখতে সম্পূর্ণ আলাদা রকমের ছিল, ছবি দেখার অভিজ্ঞতা ছিল ইনস্টাগ্রামের মত। বিষয়গুলো সংক্ষিপ্ত তথ্যাকারে সাজানো ছিল যেন আপনি খুব সহজেই বিশ্বকাপের ইতিহাস, খেলোয়াড়দের তথ্যাবলী জানতে পারেন। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম মানুষ নতুন এক উইকির পরিবেশে মোবাইল থেকে তথ্য নিতে পছন্দ করবে কিনা। এটি সম্পূর্ণই একটা গবেষণা ছিল আর আমরা দেখেছি এখান থেকে কী শেখা যায়। হয়ত আগামীতে এরকম গবেষণা আরো করা হবে।
উইকিবার্তা: ফলাফল [এই গবেষণার] কি প্রকাশিত হয়েছে?
ক্যাথরিন মা’র: এই সম্মেলনে (উইকিম্যানিয়া ২০১৯), একটি সেশনে প্রকাশিত হয়েছে।
উইকিবার্তা: এবার আসি বৈশ্বিক আন্দোলনের ভবিষ্যতের দিকে। আমরা সবার সাথে আলোচনা করে ফাউন্ডেশন থেকে নির্ধারিত কৌশলগত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে যার শুরু হয়েছিল, এখন ২০১৯-এর আগস্ট। আমাদের অগ্রগতি কীরকম? আমরা কি সঠিক পথে যাচ্ছি?
ক্যাথরিন মা’র: আমার মনে হয় এখানে দুটো ভিন্ন প্রশ্ন আছে: আমরা সঠিক পথে যাচ্ছি কিনা এবং আমরা যথেষ্ট দ্রুতগতিতে যাচ্ছি কিনা। আমি মনে করি আমরা সঠিক পথে যাচ্ছি। আমাদের লক্ষ্য কোনদিকে হওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে সম্প্রদায়ের সাথে কথা বলছি। আপনি জানেন উইকিম্যানিয়াতে প্রতিটি কৌশলগত বিষয়ের সেশনে প্রচুর মানুষ অংশ নিয়েছেন। আমরা সেখানে অনেক মানুষের অংশগ্রহণ দেখেছি, আমাদের পরামর্শের ব্যাপারে তাঁরা অনেক প্রশ্ন করে গেছেন, আলোচনা করেছেন। আমার মনে হয় এটা বেশ ভালো লক্ষণ – একটি ফলপ্রসু সম্প্রদায়ের লক্ষণ, যাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের প্রশ্ন করছে। আরেকটি বিষয় বলতে চাই, ডাইভার্সিটি (বৈচিত্র্য) বিষয়ক সেশন দেখে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি; এখানে এত মানুষ অংশ নিতে এসেছে যে, চেয়ার কম পড়ে গেছে, অন্য সেশন থেকে নিয়ে আসতে হয়েছে – এটা দারুণ! আমার মনে হয় এটা ফলপ্রসু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান লক্ষণ।
এবার আসি মূল প্রশ্নে, আমরা কি সঠিক পথে আছি? আমার মনে হয় আমরা সঠিক পথে আছি, কারণ আমরা কথা বলছি আমাদের ভবিষ্যৎ কীরকম হওয়া প্রয়োজন তা নিয়ে। আমার মনে হয় আন্দোলনগত কৌশল (মুভমেন্ট স্ট্র্যাটেজি) সেশনেও আমরা এরকম বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। আমরা যদি ৫ বছর আগেও তাঁদের সাথে এভাবে কথা বলতাম, মানুষের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন হত। আমার মনে হয় আমাদের সম্প্রদায় বড় হচ্ছে, আমরা আরো বেশি বৈশ্বিক হচ্ছি, আমরা আরো বেশি বৈচিত্র্যময় হচ্ছি, আমরা আরো প্রতিনিধিত্বশীল হয়ে উঠছি। আমরা নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আগ্রহী হচ্ছি। আপনি কিছুক্ষণ আগে প্রশ্ন করলেন উইকিপিডিয়া কিভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তা নিয়ে। আমার মনে হয় এগুলো ইতিবাচক পরিবর্তন।
আমরা কি প্রয়োজনমত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছি? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। আমার মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর একইসাথে হ্যাঁ এবং না। আমি না বলছি কারণ, আমাদের আরো দ্রুতগতিতে এগোনো উচিত। আপনি জানেন, পৃথিবী প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রযুক্তির উন্নতি হচ্ছে ভীষণভাবে। আমার মনে হয় আমাদের সবারই এটা বোঝা প্রয়োজন যে, আমাদের কাজের ব্যাপারে একটা তাড়া রয়েছে!
উইকিপিডিয়াতে Eventualism বলে একটা কথা আছে। ধীরে ধীরে বিশ্বকোষ গড়ে উঠবে এবং পরিণাম পাবে। কিন্তু আমি জানিনা এটা কতটুক সত্য। আমার মনে হয় আমাদের গোটা আন্দোলন যদি আরো দ্রুতগতিতে না এগোয়, তাহলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের মানুষের কাছে, বিশেষত তরুণসমাজের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা ততটা নাও থাকতে পারে। আমরা গত ১৫ বা তারচেয়ে বেশি বছর ধরে কাজ করছি। আমি মনে করি আমাদের বিভিন্ন আঙ্গিকে আরো দ্রুতগতিতে এগোনো প্রয়োজন, যদি আমরা বর্তমান বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে চাই।

বার্লিনে উইকিমিডিয়া কনফারেন্স ২০১৮-এ কথা বলছেন ক্যাথরিন মা’র। ছবি: নবীন/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
একইসাথে আমাদের আন্দোলনকে ধীরগতিতেও এগিয়ে নিতে হবে, কারণ আমাদের সকলের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। আমরা বৈশ্বিক স্বেচ্ছাসেবকদের একটা বিরাট গোষ্ঠী এবং আমরা সব বিষয়ে কখনোই একমত হইনা। প্রকৃতপক্ষে ভিন্নমত অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর একটি পথ যার উপরে উইকিপিডিয়া গড়ে উঠেছে, তাই না? তাই দ্রুত এগোতে গেলে হয়ত আমরা সবার সাথে কথা বলতে পারব না এবং আমি মনে করি সেটা আমাদের আন্দোলনে কাজ করবেও না। আমার মনে হয় আমাদের কিছূটা ধীরে এগোতে হবে যেন আমরা প্রয়োজনীয় আলোচনা চালাতে পারি, এবং এরপরে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।
আমরা এইসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী, কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় আলোচনা করে নিই। আমরা জানি আমাদের ট্রেড-অফগুলো কোথায়। আমরা জানি আমাদের সুযোগ রয়েছে কোথায়, আমাদের সিদ্ধান্তের চ্যালেঞ্জ রয়েছে কোথায়। আমরা জানি কারা সিদ্ধান্তের সমর্থনে রয়েছেন, কারা নেই। অনেক সময়ই সেই সিদ্ধান্তগুলো ভালো সিদ্ধান্ত হয়, এর মূল কারণ সেই আলোচনাসমূহ।
তাই আমি মনে করি আমরা দ্রুতগতিতে এগোচ্ছি কিন্তু এটি আরো দ্রুততর হওয়া প্রয়োজন। আমার মনে হয় আলোচনার ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রয়োজন। ‘এই আলোচনাটা এরকম, আমরা কি এটাকে রেখে সামনে এগিয়ে যাব নাকি আরো সময় নিয়ে আলোচনা করব’ এই বোধটা থাকা দরকার। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আমাদের মাথায় দ্রুততার সাথে এগোনোর ব্যাপারটা থাকা উচিত।
উইকিবার্তা: ধন্যবাদ। এবার আমরা জেন্ডার বৈষম্যের ব্যাপারে আসি। আমরা জানি এই অবস্থা উইকি জগতেও খুব একটা আশানুরূপ নয়, যদিও সাম্প্রতিককালে উইমেন ইন রেডসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে এক ব্লগে আপনি বলেছিলেন ইতিহাসে নারীদের জীবনে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে যুক্ত থাকে পুরুষের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবস্থা। একারণেই নারীসম্পর্কিত নিবন্ধে বিবাহবিচ্ছেদ কথাটা বেশিমাত্রায় থাকে, পুরুষসম্পর্কিত নিবন্ধে তেমনটা থাকে না। বর্তমানে এই অবস্থাটা কেমন?
ক্যাথরিন মা’র: গতকালের আলোচনা সেশনে (লাইটনিং টক) কাতালান উইকিমিডিয়া থেকে তথা আমিকেল উইকিমিডিয়া থেকে মার্ক মিকেল একটা গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন। তিনি বার্সেলোনাতে থাকেন আর তিনি একজন গবেষক। তিনি আমাদের আন্দোলনের বৈচিত্র্য বিষয়ে একটি প্রেজেন্টেশান দেন। আমাদের এ আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে থেকেই ছিল, এমন কিছু চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি কথা বলেন। আপনি যদি সারা বিশ্বের কথা এবং [আমাদের সাথে] অংশগ্রহণযোগ্য এমন যে-কারো কথা ভাবেন তাহলে উইকিমিডিয়া তার একটি সাবসেট হবে। এখানে উইকিমিডিয়া অবদানকারী হওয়ার আগে এত বেশি ফিল্টার পার করতে হয়, এত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় – সাক্ষরতার চ্যালেঞ্জ, সময়ের চ্যালেঞ্জ, যার উইকিমিডিয়া জগতে কাজ করার সময় আছে।
তিনি [মিকেল] যা বলতে চাইছিলেন, তা হল এমন কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা মূলত উইকিমিডিয়া সম্প্রদায়ের চ্যালেঞ্জ নয়। সেগুলো সারা বিশ্বের চ্যালেঞ্জ। আমার মনে হয় একটা সম্প্রদায় হিসেবে সমাধান করার পক্ষে এটা একটা ভীষণ বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এর মানে এই না যে আমরা চেষ্টাও করব না। আমার মনে হয় এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে আমাদের একটু ভিন্নভাবে ভাবা দরকার, একজন সক্রিয় উইকিমিডিয়ান হতে হলে কী করতে হয়? আপনি হয়ত উইকিমিডিয়ার প্রকল্পে মাসে একবার কাজ করার সময় পান। কিন্তু তবুও আপনি অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত আন্তরিক, আপনাকে কি আমরা সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে গণ্য করব কিনা।
আমার মনে হয় বৃহত্তরভাবে দেখলে আপনি ভিন্ন ধরণের সম্প্রদায়ের সদস্য; আপনি ভিন্ন ধরণের দৃষ্টি দিয়ে সবকিছু যাচাই করবেন, ভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবেন, আপনি ভিন্নভাবে অবদান রাখেন কিন্তু তবুও আপনি ঠিক ততটাই এ সম্প্রদায়ের সদস্য, যতটা একজন দৈনিক অবদানকারী। আমার মনে হয় আমরা যখন ঐরকম বড় চ্যালেঞ্জের দিকে তাকাই, তখন আমাদের উচিত নিজেদের সম্পর্কে সচেতন থাকা। উইকিমিডিয়ায় আমাদের নিজেদের বৈষম্য আর সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা। কিন্তু সেগুলো সমাধানে আমাদের কষ্ট হয়, কারণ এই বৈষম্য সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। তাই আমি বলি, বিশেষ করে আপনাদের মত সাংবাদিকদেরও, যখন আপনারা লিখছেন তখন নিশ্চিত করুন যেন আপনি নারীদের সম্পর্কেও লিখছেন, আপনি তাঁদের গল্পও বলছেন।
নিশ্চিত করুন, যেন আপনি নারীদের সাক্ষাৎকারও নিচ্ছেন যেন তাঁদের কথাও সবাই শুনতে পারে। আমার মনে হয় আমরা যত বেশি আমাদের ব্যক্তিজীবনে, আমাদের কর্মজীবনে এবং বলার অপেক্ষা রাখে না উইকিমিডিয়া জীবনে এইসব বৈচিত্র্য, নারীবৈষম্য আর সমতা বিষয়ে যত্ন নেব, কথা বলব, তত বেশিই উইকিমিডিয়াতে এর প্রভাব আমরা ফেলতে পারব।

উইকিপিডিয়া প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলস ও ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন মা’র। ছবি: রাইনার হালামা, সিসি-বাই-এসএ ৪.০
উইকিবার্তা: ২০১৪ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ, খুব একটা ছোট পথ নয়। আপনি যদি পিছনে ফিরে তাকান, তাহলে আপনার দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় সাফল্য কী? আমি যদি একটু অন্যভাবে বলি তাহলে কোন চ্যালেঞ্জ আপনি সফলভাবে পেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলে গর্ববোধ করেন?
ক্যাথরিন মা’র: (হাসি) হুমম…আমার মনে হয়…আমার দৃষ্টিকোণ থেকে আমি মনে করি না এটা আমার সাফল্য। তবে উইকির এ আন্দোলন, এবারের উইকিম্যানিয়া গতবছরের চেয়ে বেশ অন্যরকম মনে হচ্ছে। এবং এই পার্থক্যটা ইতিবাচক। আমার মনে হয় এবার সব খুব দ্রুত লয়ে হচ্ছে আর আমরা ভাবছি এর কারণ কী! আমরা ভেবেছি আর আমাদের মনে হয়েছে এর কারণ এবার এটা [উইকিম্যানিয়া] আরো বৈচিত্র্যময় - ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে আরো বেশি মানুষ আসছেন, তাঁরা যা নিয়ে চিন্তিত তা নিয়ে কথা বলছেন, সত্যিকারের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছেন।
একই মানুষ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন তেমনও না, বরং বিভিন্ন মানুষের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, তাঁরা কর্মশালা নিয়ে কথা বলছেন, কিভাবে আরো উন্নতি আর পরিবর্তন নিয়ে আসা যায় তা নিয়ে কথা বলছেন। আমার মনে হয় না এটা আমার সাফল্য। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের আন্দোলনের জন্য এটা একটা বড় সাফল্য, এবং আমাদের অবস্থান এখন ঠিক এখানেই। কারণ আমরা এখন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো অনেক বেশি চিন্তা করছি এবং আমরা আমাদের সমস্যা সমাধানের দিকে বেশি মনোযোগও দিচ্ছি।
আমার সবচেয়ে গর্বের জায়গাটি হল আন্দোলনের কৌশলগত অবদান, এটা এখন সম্প্রদায়ের অধিকারে, তাঁরা এটা নিয়ে গর্বিত এবং এটাকে নিজেদের বলে মনে করেন। এটা ফাউন্ডেশন করেনি, আমি হয়ত ব্যক্তি হিসেবে এর শুরুতে অবদান রেখেছি কিন্তু এটা আমার নয়। আমি ভীষণভাবে গর্বিত কারণ আমরা যে প্রক্রিয়া শুরু করেছি সেটা যথেষ্ট পরিমাণে বিস্তৃত আর উন্মুক্ত ছিল, যার ফলে মানুষ এখানে এসেছে এবং এটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি খুবই আনন্দিত কারণ এই সবের শুরুর সময় আমি ছিলাম।
উইকিবার্তা: এই সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত হওয়ার পর সবচেয়ে বড় কোন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন আপনি?
ক্যাথরিন মা’র: আমি মনে করি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল… (চিন্তিত) আপনি জানেন আমি ফাউন্ডেশন আর গোটা সম্প্রদায়ের জন্য খুবই কঠিন সময়ে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে ফাউন্ডেশনে যোগ দিই। ফাউন্ডেশন আর সম্প্রদায়ের মধ্যে তখন অবিশ্বাসের সময় চলছিল আর এটা ভয়ঙ্কর এক অনুভূতি। এটা সম্প্রদায়ের জন্য ভয়ঙ্কর, ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের জন্যও ভয়ঙ্কর। এই অবিশ্বাস পার করে আসাটা…কঠিন ছিল! অসম্ভব ছিল না, এবং আমি মনে করি এখন আমরা অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি।
আমি এই [উইকিমিডিয়ার] উদ্দেশ্যে বিশ্বাস করি, আমি এই সম্প্রদায়ে বিশ্বাস করি আর আমি জানি উইকিমিডিয়ানরা এখানে রয়েছেন কারণ তাঁরাও একই লক্ষ্যে বিশ্বাসী আর তাঁরাও সম্প্রদায়কে বিশ্বাস করেন। এটা খুবই কঠিন যখন দুই গ্রুপ একই লক্ষ্যে বিশ্বাসী কিন্তু তাঁরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারেন না। তাই আমার মনে হয় এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল – কিভাবে এমন এক সময়ে বিশ্বাস গড়ে তুলতে হবে যখন এর পরিমাণটা খুব কম অবশিষ্ট আছে! দ্বিতীয় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই যে, উইকিমিডিয়া সম্প্রদায় খুব দ্রুত বড় হচ্ছে, এই গতি ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাতেই সর্বোচ্চ। বিশ্বের বাকি সম্প্রদায় গত ১০ বা ১৫ বছর ধরে বড় হচ্ছে কিন্তু তাদের কথা শোনা যাচ্ছিল না।
আমি উইকিমিডিয়া ইউকে, উইকিমিডিয়া জার্মানি, উইকিমিডিয়া ফ্রান্সের অনেককে চিনি কিন্তু উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ বা উইকিমিডিয়া ইন্দোনেশিয়া বা উইকিমিডিয়া সাউথ আফ্রিকার অত বেশি মানুষকে চিনি না, অন্তত চিনতাম না। আমি অনুভব করি যে আমার জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ যেন এই সম্প্রদায়ের মানুষেরাও প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, যেন তাঁদের কথাও শোনা যায়। আমরা যখনই এই চ্যালেঞ্জের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি, আমরা চিন্তা করি যেন টেবিলে সব সম্প্রদায়ের জন্যই সিট থাকে এবং গোটা সম্প্রদায় শোনে, তারা কী নিয়ে যত্নশীল।

ক্যাথরিন মা’র সাথে এই প্রতিবেদক (অংকন ঘোষ দস্তিদার)। ছবি: উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ, সিসি-বাই-এসএ ৪.০
উইকিবার্তা: বর্তমানে আপনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী বলে আপনি মনে করেন?
ক্যাথরিন মা’র: আমার মনে হয় ভবিষ্যতের দিকে তাকালে উইকিমিডিয়া প্রকল্পে কিছু সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ আছে। আমি সম্মেলনের ক্লোজিং সেশনে আমাদের সমাজের বিভক্তি নিয়ে আরো কথা বলব। বর্তমানে আমাদের সমাজে আগের চেয়ে অনেক বেশি কলহ আছে। আমার মনে হয় ভুল তথ্যের চ্যালেঞ্জ আর তথ্যে বিশ্বাসের অভাব সম্প্রদায়ের জন্য বেশ আতঙ্কের, বিশেষ করে যে সম্প্রদায় কিনা পুরো বিশ্বের জন্য উচ্চমানের জ্ঞান সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত। মানুষ যদি তথ্যে বিশ্বাস না করে, তাহলে কী করে তারা উইকিমিডিয়াকে বিশ্বাস করবে? আমরা একমত হতে পারি না কারণ আমাদের সমাজ বেশকিছু বিষয়ে বিভক্ত। তারা কিভাবে জ্ঞানের ব্যাপারে একমত হবে? আর আমরা যদি জ্ঞানের ব্যাপারে একমত হতে না পারি, তাহলে কিভাবে আমরা আমাদের সমাজের জন্য আর সর্বোপরি আমাদের জীবনের জন্য ভালো এমন ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব?
তাই আমি মনে করি এগুলো উইকিমিডিয়া আন্দোলনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। আমি জানিনা আমরা যথেষ্ট দ্রুতগতিতে এগোচ্ছি কিনা, আর এও জানিনা এইসব হুমকির ক্ষেত্রে সম্প্রদায় চটজলদি এগোনোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে কিনা। কিছু মানুষ করছে, আমি জানি খুব ভালোভাবেই করছে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রভাব আর ভুল তথ্যের উপরে একটি আলোচনা হচ্ছে। বিশ্বের অনেক অনেক দেশে এই সমস্যা আছে। আমি আশা করি যে, আমরা আমাদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে সচেতন থাকব, যেন আমরা সেগুলো মোকাবেলা করতে পারি আর সফলভাবে সমাধান করতে পারি।
উইকিবার্তা: বৈশ্বিক উইকি কার্যক্রমে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
ক্যাথরিন মা’র: আমি আরো জানতে চাই! আমি কখনো বাংলাদেশে যাইনি, যার জন্য পরিষ্কারভাবে জানাটা কঠিন হয়ে গেছে হয়ত। উইকিমিডিয়া জগতে যে ব্যাপারটি আমি শিখেছি তা হল সম্প্রদায়ের কাছে সশরীরে পৌঁছানোর গুরুত্ব। আমি কখনো বাংলাদেশে যাইনি, উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনে যুক্ত হওয়ার আগে আমি কখনো ঘানা যাইনি, আর্জেন্টিনাতেও যাইনি। আমি উইকিইন্দাবা সম্মেলনের জন্য ঘানা গিয়েছিলাম, অন্য এক কাজে আর্জেন্টিনায়ও গিয়েছিলাম। এবং এখন আমার মনে হয় আমি ভালোভাবে জানি তাঁদের প্রয়োজন কী, তাঁদের চ্যালেঞ্জ কী, আর তাঁরা কোন ব্যাপারে যত্নশীল। আমার মনে হয়না আমি উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে খুব বেশি জানি। তবে আমি আরো জানতে চাই এই সম্প্রদায় কী ব্যাপারে যত্ন নেয়, কোনটা অত্যাবশ্যক আর কোন ধরণের কর্মকাণ্ডে তাঁরা গুরুত্বারোপ করে। কীভাবে উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ – বাংলাদেশে কাজ করে চলছে, কীভাবে তাঁরা এই অঞ্চলের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করে চলেছে। আমি এইসব ব্যাপারে আরো জানতে পারলে খুব খুশি হব।
উইকিবার্তা: আমরা আপনাকে বাংলাদেশে পেলে অত্যন্ত খুশি হব। বাংলাদেশে দেখা হবে আশা করি!
ক্যাথরিন মা’র: আশা করি, আমার খুবই ভালো লাগবে!
উইকিবার্তা: বাংলা সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
ক্যাথরিন মা’র (ভিডিও বার্তা): হ্যালো, উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ। আমি ক্যাথরিন মা’র, আমি উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আমি স্টকহোমে উইকিম্যানিয়ার এই সম্মেলনে আপনাদের শুভেচ্ছা জানাতে চাই আর অসাধারণ যেসব কাজ করে যাচ্ছেন তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত। আমি শুভেচ্ছা জানাতে চাই সাথে সাথে বাংলা উইকিপিডিয়া উন্নয়ন এবং পরিচালনার জন্য ধন্যবাদ জানাই। মাত্রই জানতে পারলাম বাংলা উইকিপিডিয়া ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তার যাত্রা শুরু করে, অসাধারণ ১৫ বছরের জন্য অভিনন্দন! এই কয় বছরে আপনারা নানা অসাধারণ কাজ করেছেন, এর মধ্যে রয়েছে রেডিও স্টেশন, বিমানবাহিনী, দূতাবাসের সাথে যৌথ কার্যক্রম ইত্যাদি।
কীভাবে বাংলাদেশী আর বাঙালি সংস্কৃতিকে বাংলা উইকিপিডিয়ায় নিয়ে আসা যায় এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। চমৎকার সব কাজের জন্য অভিনন্দন! আমি আরো জেনেছি আপনারা উইকিমিডিয়া লেভ্যান্ট এবং উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের সাথে আরব সংস্কৃতি ও বাংলা সংস্কৃতির আদান-প্রদানের একটি বিনিময় কার্যক্রমও পরিচালনা করেছেন। আমার মনে হয় একটি বৈশ্বিক সংস্থা হিসেবে উইকিপিডিয়া কীভাবে কাজ করে তার একটি সুন্দর উদাহরণ এটি, যেখানে আমরা শুধু নিজেদের ভাষা নিয়েই নয় বরং গোটা বিশ্বে শেখানোর পরিবেশ তৈরি করি। আমি আবারও অভিনন্দন জানাতে চাই। উইকিবার্তাকে ধন্যবাদ এই ভিডিওর মাধ্যমে আপনাদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এবং আমি বলতে চাই (বাংলায়) বাংলা উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়কে শুভকামনা জানাই!
উইকিবার্তা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ক্যাথরিন মা’র: আপনাকেও ধন্যবাদ।