
সামির এলশার্বতী। ছবি: উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন।
উইকিপিডিয়ার তত্ত্বাবধানকারী অলাভজনক সংস্থা উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনের যোগাযোগ দলের কর্মকর্তা সামির এলশার্বতী গত এপ্রিলে দুদিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন। এসময় তিনি উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সাথে একটি বৈঠকে মিলিত হন। এছাড়াও, ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপন বিশেষ করে মঙ্গল শোভাযাত্রাও অংশ নেন।
মিশরে জন্মগ্রহণকারী সামির স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে উইকিপিডিয়াতে অবদান রাখা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশনে যোগদান করেন। উইকিপিডিয়া তথা উইকিমিডিয়া প্রকল্পে তাঁর জড়িত হওয়াসহ নানা বিষয় নিয়ে উইকিবার্তার সাথে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অংকন ঘোষ দস্তিদার।
উইকিবার্তা: আপনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে আপনার উইকিজীবন শুরু করেছিলেন। গল্পটা শুনতে চাই।
সামির: আমি দীর্ঘদিন ধরে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করে আসছিলাম। আমার শুরুটা ছিল ছাত্র হিসেবে, যে কিনা উইকিপিডিয়ায় কিছু তথ্য খোঁজার জন্য ঢুকেছিল। একবার আমি কায়রোর অসাধারণ এক ঐতিহাসিক দেয়ালের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এটা বিশাল দেয়াল ছিল, মনে হচ্ছিল এটা কোনো সিটাডেল বা ওরকম কিছুর দেয়াল হবে কিন্তু ওখানে এমন কিছু ছিল না। এর আশেপাশে বিশেষ কিছুও ছিল না।
আমি ভাবছিলাম কেন দেয়ালটা ওখানে আছে, এর কাজ কী! আমার পাশে যে ব্যক্তি ছিলেন তিনি বললেন এটাকে সম্ভবত মাগরা (দেয়াল) বলে। আমি উইকিপিডিয়ায় তথ্যের আশায় ঢুকলাম। অনুসন্ধান বাক্সে অনুসন্ধান করলাম এবং দেখলাম এমন কোনো পাতা উইকিপিডিয়ায় নেই। আপনি পাতাটি শুরু করতে পারেন। আমি ভাবলাম আমি নতুন তথ্য খুঁজবই কোনো না কোনোভাবে, তো কেননা কিছু তথ্য দিয়ে নিবন্ধটি তৈরি করে ফেলি?
এভাবেই আমার শুরুটা হয়েছিল, নতুন অ্যাকাউন্ট খুললাম এবং নিবন্ধটি তৈরি করলাম। এর কয়েক মাস পর আমি শুনলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে উইকিপিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রাম নামে কিছু শুরু হতে যাচ্ছে। এবং কিছু মানুষের সাহায্যে শিক্ষার্থীরা যা পড়ে তা সম্পর্কে উইকিপিডিয়া ব্যবহার করে অবদান রাখতে শিখবে। ব্যাপারটা আমার ভালো লাগল।
আমি ছাত্র হিসেবে উইকিপিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রামে যোগদান করলাম। আমি বেশকিছু নিবন্ধ সম্পাদনা করলাম। আমি অনলাইনে ভীষণ সক্রিয় ছিলাম এবং বিভিন্ন প্রোগ্রামে আয়োজকরা লক্ষ করল আমি দ্রুত সব শিখে যাচ্ছি। পাশাপাশি আমি অন্যান্য শিক্ষার্থীদেরকেও উইকিপিডিয়া সম্পাদনার ব্যাপারে সহায়তা করতে পারছি। তারা আমাকে পরামর্শ দিল উইকিপিডিয়ান প্যাসেঞ্জার হওয়ার জন্য, যে কিনা সহপাঠীদের উইকিপিডিয়ায় অবদান রাখতে সহায়তা করে।
পরবর্তীতে তারা আমাকে উইকিপিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রামের জন্য ক্যাম্পাসের নেতৃত্ব দেবার প্রস্তাব করল। এরপর আমি এডুকেশন প্রোগ্রামগুলোতে নেতৃত্ব দেওয়া শুরু করলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নতুন মানুষদের উইকিপিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করলাম। আমি নিজের মতই সারা মিশরে ঘুরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, অধ্যাপকদের সাথে তাঁদের ক্লাসে উইকিপিডিয়া এডুকেশন প্রোগ্রাম চালুর ব্যাপারে কথা বলতাম।
এর জন্য অনেক সময় লাগত, সেইসাথে অর্থও। মাঝেমধ্যে নিজের থেকেই টাকা লাগত। হয়ত আমাদের উচিত না এভাবে এগোনো। আমার বলা উচিত না যে আমি প্রোগ্রামের জন্য নিজেই নিজের টাকা দিয়েছি (হাসি)! তবে হ্যাঁ এতে অনেক সময় এবং পরিশ্রম লাগত।
উইকিবার্তা: আমি জানি মিশরে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে আপনাকে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেখানকার পরিস্থিতি এখন কেমন? সাম্প্রতিককালে কি অবস্থার উন্নতি হয়েছে?
সামির: আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে খুব ভালোরকম ওয়াকেবহাল কোনো ব্যক্তি না। কারণ সেখানে বর্তমানে একটি ব্যবহারকারী দল (ইউজার গ্রুপ) রয়েছে। এখানে তাঁরা অসাধারণ কাজ করে চলেছেন, কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। তাঁদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাঁরা সেই সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার মাধ্যমে কার্যক্রম এগিয়ে নিচ্ছেন। তাঁদের সম্পদও ভীষণ সীমাবদ্ধ।
উইকিবার্তা: এমন একটি চ্যালেঞ্জের কথা বলুন যা কিনা আপনি সফলভাবে অতিক্রম করে এসেছেন।
সামির: যখন শিক্ষা কার্যক্রমের নেতৃত্বদানকারীরা চলে যাচ্ছিলেন সেই সময়টা আমার জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল। আমার কাছে তখন দুটো পথ খোলা ছিল, হয় কাজ ছেড়ে দেওয়া কিংবা আমার পছন্দের কাজটি চালিয়ে নেওয়া। আমি মিশরে আমার কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ আর কঠিন ব্যাপার ছিল।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপক, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতাম। তাঁদেরকে শেখাতাম …এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা ধীরে ধীরে নতুন শিক্ষার্থী এবং নতুন স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে গোড়া থেকে এই কর্মসূচীকে পুণরায় দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলাম। সেইসাথে পেয়েছিলাম সর্বোচ্চ ফলাফল। এটা আমার জন্য বেশ কঠিন ছিল।

ঢাকায় সামির এলশার্বতী। ছবি: নাহিদ সুলতান/সিসি-বাই-এসএ ৪.০
উইকিবার্তা: আপনি উইকিমিডিয়ানদের গল্প লিখে থাকেন। গল্পগুলো আকর্ষণীয় এবং শিক্ষণীয়ও বটে। আপনি কি এমনই একটি গল্প আমাদেরকে বলতে চাইছেন, যা কিনা আপনাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছে?
সামির: আমি উইকিমিডিয়া ব্লগের জন্য ব্লগ লিখতাম, এখন আর কাজটি করছি না আমি। আমি অনেকের প্রোফাইল তৈরি করেছি এবং সম্ভবত এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। মানুষের কথা শোনা, তাদের গল্পগুলো জানা এবং কী তাঁদের উইকিপিডিয়ায় টেনে এনেছে কিংবা কেন তাঁরা সম্পাদনা করেন এগুলো জানা।
এটা খুবই আকর্ষণীয় একটা কাজ কারণ বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম মত থাকতে পারে। কোন অর্থনৈতিক কোনো কাজ কিংবা বাসায় বসে থাকা বা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার বদলে আপনি কম্পিউটারের সামনে বসে ফ্রিতে কাজ করবেন? উইকিপিডিয়ার স্বেচ্ছাসেবকদের এতরকম অনুপ্রেরণা থাকে! এমন গল্প শুনতে ভীষণ ভালো লাগে।
আমি অনেক অসাধারণ আর অনুপ্রেরণামূলক গল্প শুনেছি, দেখেছি এবং লিখেছি। উদাহরণস্বরূপ, যে একটি ঘটনা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে তা হল আর্মেনিয়ার উইকিক্যাম্পস। তাঁরা টিনেজার উইকিপিডিয়ানদের জন্য একটি কর্মসূচীর আয়োজন করেছিলেন। কীভাবে তাদেরকে অংশগ্রহণ করানো যায়, এবং তাঁরা সত্যিই ভালো কাজ করেছিল।
উইকিমিডিয়া আর্মেনিয়া সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো সত্যিই অসাধারণ এবং সুসানা (প্রেসিডেন্ট, উইকিমিডিয়া আর্মেনিয়া) এবং তাঁর দল এর জন্য ভীষণ পরিশ্রম করেছে। চেক প্রজাতন্ত্রে বয়স্ক মানুষদের জন্য একইরকম একটি কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছিল। তবে এখানে একটি ব্যাপার আছে। আর্মেনিয়াতে যে কার্যক্রমটি সফল হয়েছে, সেটি বাংলাদেশেও সফল হবে এমনটা নয়। যুক্তরাজ্যে এটা সফল হবে এমন কোনো কথাও নেই।
প্রতিটি দেশ, প্রতিটি সম্প্রদায় নিজস্ব কিছু ব্যাপারে দক্ষ, তাদের নিজস্ব পদক্ষেপ রয়েছে। এছাড়াও আরো অনেক উইকিপিডিয়ান আছে যারা অসাধারণ কাজ করেছেন। যেমন জর্ডানের মোসাব, তিনি উইকিপিডিয়া জিরো প্রকল্প চলাকালীন শ’খানেক নিবন্ধ লিখেছিলেন জিরো ডেটা ব্যবহার করে। এছাড়া মিশরে রয়েছে মুহাম্মদ ওডর, যে কিনা ১৫ বছর ধরে উইকিপিডিয়ায় অবদান রেখে চলেছে। এমন আরো অনেকে আছেন।
ভেনেজুয়েলায় উইলফ্রেডো রড্রিগেজ নামে একজন ফটোগ্রাফার আছেন, তাঁকে নিয়ে আমি একটি ব্লগপোস্ট লিখেছিলাম। তিনি এত অনন্য কিছু ছবি তুলেছেন! এমন আরো অনেকে আছেন যাঁদের গল্পকে আমি অত্যন্ত ভালোবাসি।

বাংলাদেশি উইকিপিডিয়ানদের সাথে সামির।
উইকিবার্তা: “ব্র্যান্ডিং এবং বৈশ্বিক উইকি আন্দোলনে এর গুরুত্ব” ব্যাপারটি উইকিবার্তার পাঠকদের জন্য সহজে কিভাবে বলা যেতে পারে?
সামির: ব্র্যান্ডিং হল আমরা রাস্তাঘাটে যা দেখে থাকি, এটি উইকিমিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য এমন নয়। আপনি যখন কোনো একটি কোম্পানি থেকে একটি টিভি কেনেন, তখন তাদের একটি লোগো থাকে, নাম থাকে। এই নামটিই হল ব্র্যান্ডিং। আপনি একই রঙের, একই কার্যকারিতার এবং একই আকারের একটি টিভির বদলে অন্য আরেকটি টিভি কেনেন কারণ আপনি এই ব্র্যান্ডটিকে বিশ্বাস করেন।
আমাদের উইকিপিডিয়া একটি ব্র্যান্ড। আমরা পণ্য বিক্রয় করিনা, কিন্তু আমরা উইকিমিডিয়ার প্রকল্প সম্পর্কে আরো মানুষকে জানাতে চাই। উইকিমিডিয়ার প্রকল্প সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হলে আমরা কী করতে পারি? কিভাবে আমরা এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত অসাধারণ মানুষদের সম্পর্কে জানাতে পারি? কিভাবে আমরা এই ব্র্যান্ডকে উন্নীত করতে পারি যেন আরো মানুষ লেখে আর পড়ে। এজন্যই প্রয়োজন ব্র্যান্ডিং।
উইকিবার্তা: ২০৩০-এর লক্ষ্যপূরণে এটি কিভাবে অবদান রাখতে পারে?
সামির: উইকিমিডিয়া ২০৩০-এর কৌশলগত লক্ষ্য হল সঠিক সময়ে সঠিক পরিবর্তন ঘটানো। ইন্টারনেট খুব দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। আপনি যদি এই পরিবর্তনের সাথে থাকতে চান, তবে আপনাকে পরিশ্রম করতে হবে। ২০৩০ খ্রিস্টাব্দের ইন্টারনেটে পৌঁছাবার আগে আমাদের অনেক কিছুই পরিবর্তন করতে হবে। অনেক কিছুই আছে যা আমাদের উন্নীত করতে হবে, নিঃসন্দেহে ব্র্যান্ডিং তাদের মধ্যে একটি।
যেকোনো পণ্য, ওয়েবসাইট, অলাভজনক যেকোনো কিছু সম্পর্কে ব্র্যান্ডিং হল প্রথম ছবি, যা আমাদের চোখে পড়ে। অতএব উইকিমিডিয়ার ব্র্যান্ডগুলোর উন্নয়ন ঘটানোর মাধ্যমে আমরা মূলত ‘উইকিমিডিয়া কী’ এমন প্রশ্নের উত্তরের জন্য আসা মানুষের সহজতম প্রবেশকেন্দ্র তৈরি হবে। আর এটাই আমাদের চেষ্টা।

পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় সামির।
উইকিবার্তা: উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের কার্যক্রম এবং বৈশ্বিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
সামির: আমি উইকিমিডিয়া মিশর সম্পর্কে কথা বলছিলাম। সীমিত পরিসরে থেকেও কী অসাধারণ কাজগুলোই না তাঁরা করেছেন! উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই বিষয়টি প্রযোজ্য, সম্ভবত আরো বেশি প্রযোজ্য। আমি অনেককেই জানি যাঁরা সীমাবদ্ধ সম্পদের মধ্য থেকেই সেরাটা করার চেষ্টা করছেন এবং তাঁরা করছেন।
তাঁরা যা করছে এবং যা করার চেষ্টা করছে এটা সত্যিই অসাধারণ। আমি বাংলাদেশে যেতে পেরে এবং এই অসাধারণ কাজগুলোর পিছনের মানুষদের সাথে পরিচিত হতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।
উইকিবার্তা: বাংলা সম্প্রদায়ের জন্য আপনি কিছু বলুন।
সামির: আমি বাঙালিদের, বাংলা উইকিপিডিয়া সম্প্রদায়কে বলব: অসাধারণভাবে অবদান রেখে যাওয়ার জন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ। এই সম্প্রদায়ের অংশ হওয়ার জন্য, নিজের সেরাটা উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এবং গতমাসের (এপিল ২০১৯) জন্য ধন্যবাদ (হাসি)I এখানের মানুষদের সাথে পরিচিত হতে পেরে ভীষণ ভালো লেগেছে এবং আমি আশা করছি আবার এখানে আসা হবে!
উইকিবার্তা: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সামির: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।